আরশোলা ও যোগ্যতমের উদ্বর্তন

রোদ্দুরের মধ্যে কেমন মনখারাপের ভাব। অনেকটা হলুদ রং করা পুরোনো দেয়ালের চটলা উঠে গেলে যেমন হয়, তেমন। এমন রোদ্দুরে বাইরে বেরলে আর মনখারাপ করতে ইচ্ছে করে না। তবু চন্দনের ভুরু কুঁচকে আছে, ঠোঁট ঝুলে পড়েছে, গাল-ও খুব বেশি ভাঙা ভাঙা লাগছে। তারওপর চন্দন কুঁজো হয়ে হাঁটছে। হাত হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। মনখারাপের রোদ্দুর চন্দনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। বেশিদূর যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সামনে একখানা কালো মেঘ ঝুলে আছে। সে খুব তাড়াতাড়ি রোদ্দুরকে গিলে ফেলবে।
মেঘ দেখে চন্দন একটু উৎসাহিত হলো। রোদ্দুরটা যদিও মৃত মানুষের মুখের মতো হয়ে উঠছে, তবু অনেকক্ষণ হাঁটছে বলে কষ্ট কিছু কম হচ্ছে না। মেঘ চন্দনের কষ্ট কমাবে কী! চন্দন খয়েরপোল চলে এসেছে। খাল ছোট। পেরতে বড়জোর মিনিট দুই-তিন। জল বেশি না। নৌকো বাঁধা আছে। দড়ি টেনে এপার-ওপার। দড়ি টানে গুপীকাকা। ভাড়া দশ টাকা। এর কমে আজকাল কিছু হয় না। কলকাতায় দশটাকায় তিনটে ফুচকা দেয় মোটে। চন্দন ঢালু রাস্তায় খালের কাছে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলল, ‘কাকা দড়ি ছাড়ো, দড়ি ছাড়ো।’
গুপী হাত তুলল। চন্দনের কাকির কথা মনে এলো। কাকি গুপীকাকার তিন নম্বর বউ। বয়েস হবে কুড়ি-বাইশ। টরটরে। পাড়া চরে বেড়াচ্ছে।
এদিকে মেঘ আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। একদিকটা মনে হল হাতির মতো। শুঁড় একটু ভাঙা। হালকা হালকা হাওয়া ছেড়েছে। হাওয়ায় মেঘের হাতি ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে মিশে যেতেও পারে! নৌকোটা হাজার বছরের পুরোনো বোধহয়। দুলছে ভালোই। চন্দন সাবধানে উঠল। গুপীকাকা দড়ি টানছে। বৃষ্টি শুরু হলো। এখনো তাগদ বেশি নেই বৃষ্টির। চন্দন হেসে বলল, ‘শালা মেঘেও পেচ্ছাপ করে!’
গুপী খুনখুনে হাসি হাসল। বলল, ‘এ দুনিয়ায় পেচ্ছাপ করে না কে! তুই করিস, আমি করি, তোর তিন নাম্বার কাকিও করে। দুনিয়া বড় আজব জায়গা। জল না ঢোকালেও শরীর চলবে না, জল বের না করলেও। আবার সেই জলেই দ্যাখ আমি নৌকো টানি। না হলাম নিজে পার, না করলাম অন্যকে পার।’
চন্দন গুপীর চোখ এড়িয়ে ভেংচি কাটল। বিড়বিড় করল, ‘তিনটে বিয়ে, দুটো মেয়ে, তিনটে ছেলে, সেই কাকা বলে জ্ঞানের কথা! রগড় দেখে বাঁচি না। তিনটে বিয়ে করলে জ্ঞান আমারও কিছু কম হতো না। গোটা একখানা জ্ঞানের গাছ পেটে নিয়ে বসে থাকতাম।’
মেঘের হাতি কোথায় চলে গেছে, এখন পালতোলা জাহাজের মেঘ এসেছে একখানা। চন্দন টাকা দেয় গুপীকে।
গুপী কচলানো হাসি হেসে টাকা নেয়। বলে, ‘তোর কাকির খুব শখ চুঁচড়ো-চন্দননগর যাবে, জগদ্ধাত্রী পুজো দেখবে। চুড়িটা, নাকছাবিটা কিনবে। আমারও একটা লুঙ্গি কেনার ইচ্ছা।’
চন্দন গুপীর চোখে হারামিপনা টের পায়। আরও একটা দশটাকার নোট দিয়ে বলে, ‘এর বেশি নেই কাকা।’
বৃষ্টি আরেকটু বেড়েছে। চন্দন ভিজতে ভিজতে গ্রামে ঢুকবে। ভিজতে যে খুব মন্দ লাগছে, এমনটা না। এলেমেলো হাওয়া দিচ্ছে মাঝেমাঝে। কিছু মেঘ ছিঁড়ে
ছিঁড়ে নিজের মতো চলে যাচ্ছে। ধানের ক্ষেত হাওয়ায় নুয়ে পড়ছে। কালো আকাশের সঙ্গে সবুজের শেড মিলেমিশে যাচ্ছে।
চন্দন পা চালালো। এই রাস্তা এখনো ঢালাই হয়নি। মাটি ভিজে আছে। বৃষ্টি আরও জোরে নামার আগে চন্দন পৌঁছতে চাইছে। খুব দুলছে দু পাশের নারকোল গাছ। ডান হাতে কিছু টিনের ছাউনি। এলেবেলে ভাবে বানানো। খেতে কাজ করতে করতে এ ঘরে এসে একটু জিরিয়ে নেয় সব। চন্দনের মাথা ধরেছে। ভাবল বৃষ্টি আরেকটু ধরলে যাবে। ভেবে ছাউনিতে ঢুকল।
‘আরে চন্দন যে।’
গুপীকাকার তিন নম্বর বৌ সুন্দরী ছাউনির দড়ির খাটিয়ায় বসে আছে। ঢলঢলে, আদুরে চেহারা। ভেজা নীল শাড়ি শরীর জড়িয়ে আছে। খোলা চুল কাঁধ ছাপিয়ে পিঠে পড়েছে। চন্দনের মুখ কালো হলো। বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ? যাও বাড়ি যাও। তোমার ছেলেটা ছোট না? একা রেখে এসেছে? গুপীকাকা খালধারে, ছাতা নেই বোধহয়। গুপীকাকাকে একখানা ছাতা দিয়ে এসো পারলে।’
সুন্দরী চন্দনের কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখে ঝিলিক তুলে হাসে। যেন সব ধরে ফেলেছে এমন হাবভাব। মেঘ আরও কালো হয়, বিদ্যুৎ চমকায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘কেন, তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ নাকি? তোমার গুপীকাকার জন্য ছাতা নিয়ে যেতে আমার বয়ে গেছে। সে আমার জন্য করেছে কী? হাড়বজ্জাত বুড়ো। তার টাকায় সংসার চলে, না আমার রোজগারের টাকায়?’
সুন্দরী হাসতে থাকে। বলে, ‘পারলে তুমি বরং আমাকে কিছু টাকা দাও। মাগনায় চাইছি না। আমিও তোমায় কিছু দেব তার বিনিময়ে। আজ কেউ আসেনি। ব্যবসা ভালো চলছে না আজ। অথচ আমি ভাবলাম আজ বর্ষার দিন। আজ লোকজন একটু বেশি হবে।’
চন্দন আরও কুড়ি টাকার নোট বের করল। সুন্দরী কেমন করে যেন হাসল টাকা দেখে। চন্দনের আঙুল ছুঁয়ে দিল টাকা নিতে নিতে।
চন্দন যে কী করে। অস্থির লাগছে। সুন্দরী শরীর বেঁচে। না বেচে করবে কী! চন্দন ছাউনি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। আর কোনো কাজ নেই সুন্দরীর জন্য? এই এত বড় পৃথিবীর এতটুকু ছোট গ্রাম সুন্দরীর জন্য আর কোনো কাজ রাখেনি শরীর বেচা ছাড়া! ভেবে পায় না।
সামনে রাস্তা আরও খারাপ। জল জমেছে। চরণ বাগদির ঘর সামনে। আবাস যোজনায় পাকা হবে এবার। এখনো মাটির। চরণের বৌকে চন্দন মা ডাকে। চরণকে ডাকে পাখিবুড়ো। চরণ পাখি ভালোবাসে। পেটে ভাত নেই, এদিকে বিলের ধারে বসে থাকে পাখি দেখবে বলে। শীতে উড়ে আসে কত। চরণের আনন্দ ফুরোয় না।
চন্দন চরণের ঘরে ঢুকে দেখে মা কাঁদছে। পাশে চরণ কেমন হতভম্ভ হয়ে বসে। চন্দন হাতলভাঙা চেয়ারে বসে বলে, ‘মা মুড়ি দাও। খিদে লেগেছে জোর।’
চরণ ক্ষেপে যায়। ‘দেখছিস তোর মা কাঁদছে, আর এখন তোর মুড়ি চাই। কেন কাঁদছে জানতে চাইবি না একবার। হারামজাদা।’
‘কেন কাঁদছে মা?’
চরণ ভ্যাবলা হাসি হাসে। বলে, ‘আমি খুন করেছি। তাই কাঁদে।’
চন্দনের বিশ্বাস হয় না, ‘তুমি করবে খুন?’
চরণ কাশে। বলে, ‘ঘরের হাল দেখছিস? আজ যে ঝড়ে ভাঙেনি সে হলো আমাদের কপাল। কাল যে ভাঙবে না, তার কোনো নিশ্চিন্তি নেই। ঘরে চাল আছে দিন দশেকের। শুধু চাল। এবার ফসল ভালো হয়নি। টাকা নেই। খুন না করে আমি করব কী? মেশিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হাইরোডের ওপাশে ধাবা। সেখানে গিয়ে শুধু মেরে আসতে হবে। তাতেই দশ হাজার। খুন না করে আমি করব কী! এই খুনটা ঠিকঠাক হলে আরও কাজ দেওয়ার কথা। তা সে খুন আমি ভালোই করেছি। মন দিয়ে করেছি। মরে গেছে তাতে কোনো সন্দেহও নেই। তা এতকিছু তোর মা বোঝে না। ঘ্যানঘ্যান করে শুধু কাঁদে।’
চন্দন নড়েচড়ে বসে। ‘পুলিশ এলে করবে কী পাখিবুড়ো?’
চরণ চিন্তিত মুখে বলে, ‘সে বিষয়বস্তু খারাপ হবে না। জেলে খাবার অভাব নেই।’
চন্দন উঠে পড়ে। কোথায় পৌঁছতে চাইছে গোলমাল হয়ে যায়।
বিরক্তিকর বৃষ্টি হয়েই চলেছে। পাশের শুকনো ডোবা জলে টইটম্বুর। ডোবা পেরিয়ে, ফালি রাস্তায় একখানা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। এই ভ্যানে সব্জি বেচে মাধবদা। তবে মাধবদার কিছু ঠিকঠাক নেই। কখন আছে, কখন উধাও। ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক। এখন মাধবদাকে দেখা যাচ্ছে না। খোলা ভ্যানে, তাপ্পি মারা ছাতায় মাথা ঢেকে কুনবুড়ি বসে। কুনবুড়ির আসল নাম জানে না চন্দন। মাথায় নাকি খুব উকুন। তা উকুনবুড়ি ভাঙচুর হয়ে হয়েছে কুনবুড়ি।
চন্দন চেঁচিয়ে বলল, ‘বৃষ্টি মাথায় করে ভ্যানে বসে আছ কেন? বাড়ি যাও।’
কুনবুড়ি হেসে নিজের পায়ের দিকে দেখায়। চন্দন কুনবুড়ির পা দেখার আগে মুখ দেখে শুধু। মুখে একখানাও দাঁত নেই। হাসলে মনে হয় সদ্যজাত হাসছে।
কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। চন্দন বাজের শব্দ শুনেও ঘাড় ঘোরালো না। সে এখন তাকিয়ে আছে কুনবুড়ির পায়ের দিকে। সমস্যা বাঁ পায়ে নয়, ডান পায়ে। গোড়ালির পর থেকে ডান পায়ে আর কিছু নেই। সাদা পাতলা পলিথিনে জড়িয়ে আছে গোড়ালি। চন্দন ভাবনায় পড়ল। কদ্দিন গ্রামে আসে না সে? মাস চারেক হবে। তারমধ্যে এত কিছু!
‘ভাইপো চাষ দিয়েছিল। ফসল হয়নি ভালো, জানিস তো। তার বৌ-এর আবার বাচ্চা হলো। টাকার টানাটানি, অশান্তি। বলে তোমাকে খাওয়াতে পারব না। রোজ খিটখিট। শেষে মরতে গেলাম স্টেশনে। মরলাম কচু, মাঝখান থেকে বাদ গেল এই পা-খানা।’
‘মরতেও ভালো করে পারলে না বুড়ি? বুড়ো বয়সে এক পা, এখন লাগে কেমন?’
‘এখনই বরং লাগে ভালো। মাধব হাওয়া। ভাইপো এই ভ্যানে বসিয়ে স্টেশনে নিয়ে যায় সক্কাল সক্কাল। স্টেশনে সারাদিন বসে ভিক্ষা করি। সংসারে টাকা দিই। এখন আমি রোজগেরে। সংসারে খিটমিটও এখন অনেক কম। কী বুঝলি বাপ?’
কুনবুড়ি হাসতে থাকে চন্দনের কেমন রাগ হয়। চন্দনের মনে পড়ে না সে কে, সে কেন! পৃথিবী জুড়ে শুধু বেচাকেনার মানুষ। সুন্দরী শরীর বেচে, চরণ বেচে আত্মা, কুনবুড়ি বেচে দুঃখ। শালার দুনিয়া। ক্ষিদে সব হারামজাদাকে গিলে নেয়, কতরকম যে ক্ষিদে!
হুলস্থুল রকমের বৃষ্টি শুরু হলো। নদী ঠেলে এবার জল ঢুকবে গ্রামে। বড়কাছারির ইস্কুলে গিয়ে উঠবে সব এরপর। খিচুড়ি খাবে। ত্রাণের অপেক্ষা করবে। ত্রাণের অপেক্ষা করতে করতে জীবন কেটে যাবে।
চন্দন গ্রামের শেষ মাথায় এলো। এখানে তার বাড়ি। বাড়ি পেরিয়ে মাঠ, গাছপালা, তারপর নদী। ঘরের অবস্থা খারাপ। চারপাশে আগাছার জঙ্গল। সবকিছু খুব অন্ধকার আর বিষণ্ন। চন্দন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শহরে চায়ের দোকানে কাজ করে আর ক’টাকা হয়! নিজের একটা দোকান দেবে ভাবছে এন্টালির দিকে। স্বপ্ন। তার চব্বিশ বছরের জীবনে এক মিনিটও বসার সময় নেই। বাবা চলে গেছে বছর ছয়েক। তারপর থেকে শুধু হাঁটাহাঁটি। চন্দন ঘরে ঢোকে।
মা শুয়ে আছে মাদুরে। চন্দনকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসে। ‘এই বৃষ্টি মাথায় করে এলি বাপ? ছাতা নেই? ছাতা কিনিস না কেন?’
ছাতার পেছনে খরচ করতে ইচ্ছে করে না, সেকথা বলে না চন্দন। হাজার তিনেক টাকা নিয়ে এসেছে মাকে দেবে বলে। সেটা বের করে। পলিথিনের মধ্যে টাকা। পলিথিন গার্ডার দিয়ে আটকানো। নাহলে ভিজে যেত কখন।
টাকা হাতে নিয়ে মা কাঁদে। সংসার যে কেন এমন! খালি যুদ্ধ। বিনু বাগদির বৌ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে অশান্তির জ্বালায়, সেই গল্প করে।
চন্দন এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘বোন কই?’
বোন আছে কোথাও। মা পরিষ্কার করে বলে না। চন্দনও পরিষ্কার করে জানতে চায় না। মায়ের হাতে নতুন মোবাইল দেখে। চন্দনও বেচাকেনার লোক। সে চা বেচে। বোনকে বেচে কে? মা? চন্দনের মাথা গুলিয়ে যায়।
সে ভালো করে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের মুখ নেই। হাত নেই, পা নেই। স্রেফ খয়েরি রঙের একটা শরীর আর কিলবিলে শুঁড়। মা নয়, নোংরা, গন্ধওলা আরশোলা।
চন্দন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ভ্যানের ওপর কুনবুড়ি। কুনবুড়ি না। তাপ্পিওলা ছাতা মাথায় বসে আছে আরশোলা। চরণ বাগদী কই? আরশোলা। সুন্দরীও সুন্দরী নেই আর। আরশোলা।
এ গ্রামে সবাই আরশোলা। এরা সব্বাই দিনের পর দিন যেভাবে হোক বেচে থাকবে। পৃথিবী মরে যাবে, এরা থাকবে। চন্দন ভরা বৃষ্টির আকাশের দিকে তাকায়। হাজার হাজার আরশোলা উড়ছে। পৃথিবী আরশোলায় ভরে যাচ্ছে।
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য কবি ও গল্পকার। সম্প্রতি তাঁর তিরিশটি গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।