সন্‌জীদা-আপা

সন্‌জীদা-দির প্রয়াণের পর একাধিক মুদ্রিত লেখা পড়লাম, কিন্তু কোনো একটা অভাব যেন আমাকে পীড়িত করতে লাগল। না, আমি তাঁর পরিচিত ছিলাম, কয়েকবার দেখাও হয়েছে নানা অনুষ্ঠানে, এমনকি একবার প্লেনে সহযাত্রী হিসেবে, কিন্তু যাঁকে বলে ঘনিষ্ঠ পরিচয়, তা তাঁর সঙ্গে ছিল না।  তিনি আমার নাম ও পরিচয় জানতেন, এই মাত্র—দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় হতো।  তাও গত তিরিশ বছরের মধ্যে। তবে তাঁর পুত্র পার্থের সহধর্মিণী লাইজা অসামান্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সে আমার পরম স্নেহাস্পদা; লাইজার দাদা লন্ডনপ্রবাসী ডা. ইমতিয়াজ আহমেদও আদ্যন্ত রবীন্দ্রনিবেদিত প্রাণ, অতিশয় গুণী শিল্পী ও সংগঠক। আমি বলব, তার চেয়ে তাঁর প্রাক্তন স্বামী প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে ১৯৮৮ সালে এক-দু দিনের সাক্ষাতেই আমার পরিচয় অনেক অন্তরঙ্গ হয়েছিল। তিনি আমাকে ছায়ানটে তাঁদের কাজের কথা, রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের কথা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন, এবং আমাকে দিয়ে ‘উই শ্যাল্ ওভারকাম’ গানের একটা বাংলা সংস্করণ করিয়ে নিয়েছিলেন। সেই জীবনপূর্ণ টগবগে মানুষটির স্মৃতি আমার কাছে এখনো অনেক জীবন্ত।  
তবু সন্‌জীদা খাতুনের বিষয়ে না-জানা, বা তাঁর সম্বন্ধে উদাসীন থাকা সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির পক্ষে একটা অপরাধ। আমি শ্রদ্ধা ও বিস্ময় নিয়ে তাঁর কাজকর্ম অনুধাবন করবার চেষ্টা করেছি, এবং এটা বুঝেছি যে, শুধু বিদ্যাসন্ধান, সংগীতচর্চা, সংগঠন ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব নয়, তাঁর মধ্যে, রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে, নিজের ও অন্যদের জীবন-নির্মাণেরও একটা আদর্শ ছিল। তাঁর নিজের পরিবারের মধ্যেও তিনি সেটা সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছেন। তা কেন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের বহু মানুষের মধ্যেই রবীন্দ্র-সংস্কৃতি ও জীবনবোধকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। আমি জানি না, এ বিষয়ে তাঁর জন্মপরিবারের বা তাঁর পিতামাতার কোনো ভূমিকা ছিল কি না। তাঁর আত্মজনেরা হয়তো এ বিষয়ে আরও বলতে পারবেন, বা তাঁর আত্মজীবন কথায় এ বিষয়ে খবর পাওয়া যাবে।  আমি এখনো তা পড়বার সুযোগ পাইনি। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন প্রজ্ঞাশীল মানুষ ছিলেন, সন্‌জীদার প্রজন্মের রবীন্দ্রপ্রীতি উত্তরাধিকারহীন বলে মনে হয় না। যাই হোক, আমাদের মনে হয়, আমাদের অনেকের মতো, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে ধর্মীয় ঈশ্বরের একটি বিকল্প হিসেবে ধরা দিয়েছিলেন।  এই বিষয়টি নানা শোকলেখে তত স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।

আমাদের যৌবনকালে বেশ কিছু দিন, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের কণ্ঠে  রবীন্দ্রসংগীত শুনব এই প্রত্যাশা আমাদের তেমন ছিল না। এই অপ্রত্যাশা আর অবিশ্বাসের মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গের বিপুল জনপ্রিয় আর জ্যোতিবিভাসিত শিল্পীদের পাশ কাটিয়ে কিছু রবীন্দ্রসংগীত এসে পড়ত কলকাতায়, শুনে আমরা বিস্মিত ও মুগ্ধ হতাম। না, এটা হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নয়। কিন্তু ‘পাকিস্তান’—এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত, কারণ তখন ধর্মনির্ভর জাতীয়তার ভিত্তিতে তৈরি নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চা রাষ্ট্রের অনুমোদিত নয়, এই ধারণা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও আমি শান্তিনিকেতনে প্রশিক্ষিত আবদুল আহাদের নাম জানতাম, কারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো বরণীয় শিল্পীর প্রথম দিককার রেকর্ডে তাঁর নাম সংগীত পরিচালক হিসেবে উল্লিখিত দেখেছি। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের গান শোনবার সুযোগ হয়নি কখনো।  কলিম শরাফীর নামও জানতাম, বহুরূপীর নাট্যদলের সূত্রে বেশি করে, কিন্তু তাঁরও গান আমি অনেক পরে শুনেছি। তখনো ক্যাসেটের যুগ তেমন করে তৈরি হয়নি। কিন্তু সন্‌জীদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুন এই দুই বোনের সম্ভবত ৪৫ ঘুরনের চাকতি-রেকর্ড পেয়েছিলাম, তাঁদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কারা এই দুই বোন, কীভাবে তাঁরা রবীন্দ্র সংগীতে এলেন, কীভাবে রবীন্দ্র সংগীতের অভ্যন্তর-রসকে এমনভাবে অনায়াসে আয়ত্ত করলেন। তখনই শুনেছিলাম এঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক এবং সাহিত্য-মনীষী কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা। বোনের প্রথম জনের জন্ম এপ্রিলের চৌঠা, ১৯৩৩এ।  তাঁরই দীর্ঘ জীবনের ছেদ পড়ল এই ২৫ মার্চ, ২০২৫।  আর ক-দিন বাঁচলেই তিনি তিরানব্বই বছরে পা দিতেন।
মৃত্যু নিয়ে অযথা বাগ্‌বিস্তার করা আমাদের নীতি নয়, বিশেষত যে মৃত্যু একটা জীবনকে পরিপূর্ণ করে আসে, সেই মৃত্যু নিয়ে। এ রকম জীবন নিয়ে মৃত্যুর অহংকার করার কিছু থাকে না। বরং লজ্জিত হওয়ার অনেক কিছু থাকে।  কারণ, সন্‌জীদাদি, প্রিয় অনুজ-অনুজাদের ভাষায় মিনুদি, এমন মানুষ যাঁরা মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে খুব বেশিভাবে, খুব বেশি করে বাঁচেন। নানা রকম কাজ, সৃষ্টি, আয়োজন ও স্থাপনার মধ্যে বাঁচেন। এ রকম বাঁচা মৃত্যুর পছন্দ করার কথা নয় কারণ ওই বিষয়গুলোই এক জন মানুষের মৃত্যুকে আমাদের কাছে তুচ্ছ করে দেয়, মৃত্যুর অবমূল্যায়ন ঘটায় বলা চলে, তার বেঁচে থাকাকে অনেক বেশি স্থায়ী ও মহিমময় করে তোলে। আর সন্‌জীদা নিজেও, নিজের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতেও মৃত্যুকে যেভাবে উপেক্ষা করে গেছেন তাতে মৃত্যুর আরও অপমানিত বোধ করার কথা। শেষ সাত দিন তিনি প্রায় কোমায় ছিলেন শুনেছি, কিন্তু তাঁর নাতনি সায়ন্তনী ত্বিষা তাঁকে দেখতে গেছে ওই স্কয়ার হাসপাতালে, সেখানে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছে তাঁর কোন্ গান মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের, তিনি কখনো উত্তর করেছেন, ‘ঝরাপাতা গো আমি তোমারই দলে’, কখনো ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’ কখনো ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি, ফিরিবে কি?’ হায়, যে মানুষ রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে, তাকে নিয়ে মৃত্যুর বড়াই করবার কিছু থাকে না।  মৃত্যু বুঝতে পারে যে, সে তাঁর মরদেহটার দখল নিয়েছে মাত্র, মনটাকে দখল করতে পারেনি। সে এই জীবনের কাছে পরাজিত।  
বাড়িতে সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার বাতাবরণ ছিল, কন্যাসন্তানদের শিক্ষার কোনো ত্রুটি রাখেননি হোসেন দম্পতি। সন্‌জীদা আপা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন, এবং এতে তাঁর মায়ের প্রশ্রয় ছিল। পিতাও সানন্দে সম্মতি দেন। তার আগেই স্কুল-জীবনে তিনি ব্রতচারী করেছেন, আবৃত্তি আর অভিনয়ও করেছেন, গান শিখেছেন সোহরাব হোসেনের কাছে পল্লিগীতি, নজরুলগীতি, আধুনিক; হুসনে বানু খানমের কাছে ঢাকায়, আর পরে শান্তিনিকেতনে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রভৃতির কাছে রবীন্দ্রসংগীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স করেছেন ১৯৫৪তে, পর বছরই বিশ্বভারতী থেকে বাংলায় এমএ।  পরে ১৯৭৮এ ঢাকা থেকে পিএইচডি করেছেন। পড়িয়েছেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ও ইডেন কলেজে, পরে নিজের বিদ্যামাতৃকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর গুণমুগ্ধ বহু ছাত্রছাত্রী পরে খ্যাতি অর্জন করেছে। তাঁর কৃতী ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিচারণা থেকে বুঝি, অধ্যাপনা তাঁর সাধনার একটি দিক, যাতে তিনি বিশেষরূপে সফল। 
তাঁর নিরলস জীবনচর্চার আর-একটি দিক ছিল গ্রন্থরচনা, এবং তা শুধু জীবিকার ভিত্তি নির্মাণের জন্য নয়, নিজে সন্ধান ও বিস্তারের জন্য এক বিপুল ব্যাকুলতার পরিচয় পাই এই একটি কাজে—বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে গ্রন্থ লিখেছেন একাধিক—যেমন, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ : বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা, আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা, সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি, জীবনবৃত্ত ইত্যাদি।  ওপরের তালিকা থেকে তাঁর দুটি পরিচয় স্পষ্ট হয়।  এক, তিনি মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে শুধু অ্যাকাডেমিক কৌতূহল ও গবেষণার বিষয় হিসেবে দেখেননি, তাঁকে তাঁর জীবনসাধনার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। আর দুই, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাঙ্গীণ সমর্থক ছিলেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তন তাঁকে তাঁর অন্তিম শয্যাতেও ব্যথাহত করেছিল।   

শুধু এইখানেই একজন বুদ্ধিজীবীর জীবন সীমাবদ্ধ হতে পারত, কিন্তু সন্‌জীদা এই গণ্ডিকে বহুদূর অতিক্রম করবার জন্যই জন্মেছিলেন। তিনি বাঙালির জীবনচর্যাকে রবীন্দ্রচর্যার অক্ষয় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।  প্রচলিত ধর্মসাধনা ও ঈশ্বরবিশ্বাসের বিকল্প এক সংস্কৃতি তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টিকে অবলম্বন করে। তাই তিনি গড়ে তুলেছিলেন দুটি প্রতিষ্ঠান, প্রয়াত স্বামী ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে মিলিত উদ্যোগে।  একটি সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছায়ানট, যা ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দাবি করে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই রবীন্দ্রজন্মশত বার্ষিকীর বছরে, যখন এই শতবার্ষিকী পালনই ছিল পাকিস্তানি শাসকের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আর একটি সারা বাংলাদেশে বিরামহীন ও সীমানাহীন রবীন্দ্রসংগীত চর্চার দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠান—রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ। এই পরিষদের শাখা প্রতিটি জেলায়, মহকুমায়, থানায় বিস্তারিত।  সেগুলো আসলে মূলত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার দূর-দূরান্তরে বিস্তৃত আঞ্চলিক বা প্রান্তীয় কেন্দ্র। কিন্তু সেগুলোর কাজ শুধু শিক্ষাদান নয়, যদিও তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের এই শিক্ষাদানে ছায়ানটের প্রশিক্ষিত শিল্পীরা বাসে, ট্রেনে ও নানা বাহনে সেই সব কেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষাদান করেন। এমনকি সন্‌জীদাদি আর ওয়াহিদুল ভাইও গেছেন, এ কথা আমি ১৯৮৮ সালে স্বয়ং ওয়াহিদুল ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম।  মনে রাখতে হবে, এই উদ্যোগই পাকিস্তানি সরকারের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহের স্পর্ধা বলেই গণ্য হয়েছিল। এ এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা প্রকাশ্য অন্তর্ঘাতের প্রকল্প।
ওই গান শেখানোর পর সে সব কেন্দ্রের প্রশিক্ষিত শিল্পীদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়, খানিকটা পিরামিডের মতো পরিকল্পনায়।  গ্রাম থেকে তারা থানায় আসে, উত্তীর্ণ হলে থানা থেকে মহকুমায় যায়, মহকুমা থেকে জেলায়, জেলা থেকে বিভাগে এবং শেষে বিভাগ থেকে রাজধানীতে।  এইভাবে একটি ব্যাপক ছাঁকনির মতো করে গ্রামের প্রান্ত থেকে যোগ্য শিল্পীদের জাতীয় আলোর কেন্দ্রে তুলে আনা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে গত কয়েক দশলে বাংলাদেশ থেকে যে অসংখ্য প্রথম শ্রেণির রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী উঠে এসেছেন, তার মূলে আছে এই রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ, যা ছায়ানটেরই একটি জাতীয় বিস্তার বলতে পারি। এটিও ছায়ানটকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র দিয়েছে।
ছায়ানটের সূত্র ধরে সন্‌জীদাদি আর ওয়াহিদুল ভাইয়ের আর-একটি স্থায়ী কীর্তি হলো ঢাকার রমনার বটমূলে (আসলে অশ্বত্থের ছায়ায়) পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান। শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ দিয়ে, তার পর প্রায় তিনশো ছায়ানটের ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, লালন, আবদুল করিম শাহ ও অন্যান্য পল্লিসাধকদের গান, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। ওই উপলক্ষ্যে ঢাকার বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে প্রায় মেলা বসে যায়, এবং অনুষ্ঠানস্থলটি হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হয়। বাংলাদেশে এইভাবে নববর্ষে দিনটি একটি জাতীয় উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র এইভাবে এ পর্যন্ত নববর্ষ পালিত হয়ে এসেছে। এখনকার বিভ্রান্তিকর অবস্থায় কী হবে তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি।
ছায়ানট প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী সন্‌জীদার ইচ্ছাকে সম্মান দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের সুরে তাঁকে শেষ বিদায় দিয়েছে, এবং ওই ইচ্ছাকে সম্মান দিয়েই তাঁর মরদেহ চিকিৎসার জন্য দান করেছে। এটার জন্য এখনকার বাংলাদেশের  গরিষ্ঠের জনমতের কাছে ছায়ানটকে সমালোচিত হতে হয়েছে, তা আমরা সমাজমাধ্যমে লক্ষ করেছি। সন্‌জীদা জান্নাত বা স্বর্গে যাবেন কি না এ নিয়ে প্রচুর লোক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে, কারণ তাঁর নিয়মমতো জানাজা হয়নি।  সন্‌জীদা নিজে এ নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, তাঁর পরিবার এবং তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ছায়ানটও তাতে ভ্রূক্ষেপ করেনি, কারণ তিনি ও প্রয়াত ওয়াহিদুল হক ভাই ছায়ানটকে সেই উদার মানবিক আদর্শেই তৈরি করেছেন।  আমরাও লক্ষ করেছি যে, বাংলাদেশের তথাকথিত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরও ছায়ানট সমাজমাধ্যমে সেই আদর্শ অনুসারে রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধের স্মারক নানা গানের প্রচার করে চলেছে, বাংলাদেশের অগণিত চেনা-অচেনা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীও তাই করছেন। এ এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিস্পর্ধা, যা থেকে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এখনো বাংলাদেশে পরাভূত হয়নি।
তাঁর জান্নাতবাসের সুযোগ হোক বা না হোক, দুই বাংলার স্মরণে মননে তিনি যে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  আশা করি তাঁর জীবনের আদর্শও কোনো কোনো মানুষকে আকৃষ্ট করবে। আমি তাঁর জীবৎকালে তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাইনি। এখন আমি তাঁর স্মৃতিকে প্রণাম করি।


পবিত্র সরকার প্রাবন্ধিক এবং গবেষক। ভাষাবিজ্ঞান ও ব্যাকরণ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, ইংরেজি শিক্ষা, রম্যরচনা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, রবীন্দ্রসংগীত, আত্মজীবনকথা—সব মিলিয়ে তাঁর নিজের বই সত্তরের ওপর, সম্পাদিত পঞ্চান্নটির মতো। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।  

menu
menu