বইপড়া : বোধের আতশকাচ

একটি মৃতপ্রায় নদীর নাম-নেয়া সাহিত্য সৃষ্টিপ্রয়াসী পত্রিকা ঘুংঘুর! এগারো বছর ধরে নিয়মিত বের হচ্ছে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমার অগ্রজপ্রতিম হুমায়ূন কবির। তিনি ছোট্ট ও দায়িত্বশীল একটি দলকে এমনভাবে সংগঠিত করেছেন যে নিয়মিত বের করার মতো দুরূহ কাজ সম্পন্ন হয়ে চলেছে। হুমায়ূন কবিরের ঘুংঘুর যেন দুইটি ফল্গুধারায় একত্রে বয়ে চলে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে সাধারণত বৈদ্যুতিন ডাকে আসা লেখার নির্বাচিত সমাহার ঘটে একটি ধারায়, কখনো কখনো অন্য ধারাটি প্রবল হলে ওঠে অতিথি সম্পাদকের পরিকল্পনায় ও আহ্বানে পাওয়া রচনার সমাহারে। প্রতিষ্ঠাতা ও মূল সম্পাদক হুমায়ূন কবিরের মতোই নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা ২০২৫ উপলক্ষ্যে প্রকাশিতব্য ঘুংঘুর-এর সংখ্যাটির অতিথি সম্পাদকও মেরিল্যান্ডবাসী আমার অতি নিকট অগ্রজপ্রতিম একজন, আশরাফ আহমেদ। কয়েক দিন আগে ‘বিশ্ব বই দিবস’ উপলক্ষ্যে দেয়া আমার ফেসবুক পোস্ট দেখে তিনি আহ্বান জানালেন বইপড়া নিয়ে রচিত How to Read a Book বইটি নিয়ে কিছু লিখতে। পত্রিকাকে তো নির্দিষ্ট সময়ে বের হতে হয়। সুতরাং চাইলেও আমাকে সময় দিতে পারবেন না। সেজন্য তাঁর আহ্বান মানে আমার কাছে আদেশ! সুতরাং এতে খানিকটা নির্দয়তাও রয়েছে! কিন্তু সমস্যা হলো, লেখক হিসেবে আমার তো হুকুম পালনের সামর্থ্য থাকতে হবে! দিনানুদৈনিক কাজের ফাঁক গলিয়ে এমন একটা বই নিয়ে লিখতে হলে এই বই-নির্দেশিত উপায়েই তো আগে বইটি পড়তে হবে! তা যে আশরাফ আহমেদের নির্দেশ মান্য করা সত্ত্বেও আমি পেরে উঠব না তা আর কেউ না জানলেও নিজে তো জানি! তৎক্ষণাৎ তাঁকে সে কথা জানালামও! কিন্তু তিনি আমার সত্যকে তাঁর সত্য দিয়ে ঢেকে দিলেন; আদেশকে তুলে দিলেন আরো চড়া মাত্রায়! তাই ভাবলাম, এখন উপায় তো একটা বের করতে হবে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে! অর্থাৎ লেখাটা সম্পন্ন হয়ে না উঠলেও লিখতে চাওয়ার ভাবনাটুকুই লিখে দেব! যেই ভাবা সেই কাজ, তাঁর দেয়া সময়সীমা শেষ হয়ে আসায় বইপড়া নিয়ে লিখতে চাওয়ার ভাবনাটুকুকেই লেখা হিসেবে ছেড়ে দিলাম!
২
খুব ছোটবেলাতেই আমাদের সময়ে বহুলশ্রুত ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেছিলাম, খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে লেখাপড়াই করতে হবে। বেঁচে থাকার ভালো দিকগুলোর প্রতি লোভী হয়ে উঠতেও বেশি সময় লাগেনি। এই জীবনবোধও ততদিনে গড়ে উঠেছে, বাঁচতে হলে খাওয়া-পরার বিকল্প নেই বলে এর যোগাড়যন্ত্রের জন্যই লেখাপড়া করত হবে! কিন্তু যত সময় যেতে লাগল ততই কঠিন হয়ে উঠতে লাগল লেখা-পড়া! বুঝতে লাগলাম, খেয়েপরে বাঁচার লেখাপড়ায় আমি খুব একটা সুবিধা করতে পারব না! কী করে পারব, কেজো পড়া যে কুইনিনের মতো তেতো লাগে!
তবে ছোটবেলায় ‘পাঠ্যবই’ পড়ার ব্যাপারে একটা শুধু ব্যতিক্রম ছিল, ওপরের ক্লাসের বাংলা বইপড়া! ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়তে পড়তেই বুঝি বা না-বুঝি নাইন টেনের বাংলা বইয়ের সব গদ্যাংশ ও পদ্যাংশও আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। আর পড়া হয়ে গিয়েছিল শরৎচন্দ্রের অনেকগুলো বই! ছোটমামার বাসায় নজরুল রচনাবলীর চারখণ্ড পেয়ে যাওয়ায় পড়া হয়ে গিয়েছিল সে-সবও; আর পড়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। ভালোভাবে না বুঝলেও যে পড়তে কেন ভালো লাগত আমার তা কিছুটা বুঝেছি অনেক পরে! মনে হয়েছে, সাহিত্যের প্রতি আমার আকর্ষণ প্রকৃতিগত; তা না-হলে ভালোভাবে না-বুঝেও কীভাবে পড়ে ফেলতে পেরেছি সে-সব বই! বন্ধুদের কাউকে কাউকে দেখেছি কোনো কিছু পড়লে চট করে বুঝে ফেলে ও তার সারসংক্ষেপ করে ফেলতে পারে। কিন্তু বুঝতে পারি আমি তেমনটা ভালোমতো পারি না! ধীরে ধীরে আরও বুঝলাম, আমার মধ্যে বইপড়ার প্রতি প্রকৃতিগত আকর্ষণ আছে, কিন্তু কম আছে পাঠ করে অনুধাবন করার সামর্থ্য! সামর্থ্য যে কম আছে সেটা আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি আশির দশকের গোড়ায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর। ওখানে যাওয়া-আসা শুরু করার পর আসলে বই পড়তে কছুটা শিখেছি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও অন্যান্য অনেকের সঙ্গে মিলে একই বই পড়তে গিয়ে। তখনই বুঝতে শুরু করলাম পাঠকভেদে বইয়ের আস্বাদন ও অনুধাবন ভিন্ন হয়! সে কারণে একই বই সম্পর্কে পাঠকেরা দেন ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা!
টানা বেশ কয়েক বছর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি সরাসরি বিচিত্র পাঠকদের সঙ্গে মেলামেশা করারও সুযোগ পেয়েছি। এক অর্থে পড়তে শেখার এটাও ছিল আমার প্রকৃতির পাঠশালা। তখনো পৃথিবীকে জানা-বোঝার জন্য বই ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। ফলে সামান্য কৌতূহলী মানুষ বা জিজ্ঞাসু মাত্রেরই বই পড়তে হতো! সম্ভবত মননশীলতার সামান্য যে অনুশীলন আমার চলেছে তার মাধ্যম সব সময়ই বইপড়া ও সেসব বিষয়ে ওয়াকিবহালদের সঙ্গে আড্ডা! আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম বলে একই সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকেরাও ছিলেন! এ ব্যাপারে ওপরের ক্লাসের পাঠ্য বইয়ে পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র রচনা-সংকলনের অন্তর্গত প্রবন্ধ ‘বই কেনা’-রও প্রভাবের কথা মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে, প্রমথ চৌধুরীর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধটির কথাও! এই দুটি প্রবন্ধ মনে হয় পড়াশোনায় আমাদের সমসাময়িক সামান্য আগ্রহী বাঙালি পাঠকদেরও প্রেরণার উৎস ছিল!
৩
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরির দায়িত্ব পালনের সময় লক্ষ করতাম ‘সচ্ছল মধ্যবিত্ত’ পরিবারের বেশ কিছু মধ্য বয়সী গৃহিণী নারী-পাঠককে নিয়মিত বই পড়তে। ‘সচ্ছল মধ্যবিত্ত’ নারীদের কথা মনে পড়ল এ কারণে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত কিন্তু গৃহসংসারই তাঁদের কর্মক্ষেত্র। ফলে যাপিত জীবনে বাড়ির বাইরের কাজের তেমন ব্যস্ততা ছিল না। গৃহকর্মের পরও কিছু সময় তাঁরা পেতেন বই পড়ার জন্য! ফলে বই পড়া ছিল তাঁদের সূক্ষ্ম বিনোদনের মাধ্যম। সাম্প্রতিককালে আর সেই রকম মধ্যবয়সীদের লাইব্রেরিতে যেতে দেখা যায় না। অবশ্য মধ্যবয়সী কেন, উল্লেখ করার মতো সংখ্যক পাঠককেই আর নিয়মিত লাইব্রেরিতে যেতে দেখা যায় না। ওই রকম অবস্থায় যাঁরা আছেন তাঁরা হয় পেশাগত ব্যস্ততায় সংসার সামলে আর সময় পান না, না-হয় তাঁরা নিজেরাই বই কিনে পড়েন, লাইব্রেরিতে যেতে পারেন না যাতায়াতের ব্যয়বহুলতা অথবা নানা বাস্তব ঝঞ্ঝাটের কারণে। তাঁদের কথা মনে পড়ল, কারণ তাঁরা খালি উপন্যাস পড়তেন নিছকই বিনোদন লাভের উদ্দেশ্যে। অল্পদিন পরেই তাঁরা অনিয়মিত হয়ে পড়তেন। অভিযোগ করতেন যথেষ্ট নতুন বই নাই বলে। আসলে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর লঘুতাটুকুই তাঁদের আস্বাদ্য। কারণ তাঁদের জীবনাগ্রহের সঙ্গে অন্য মননশীল বইয়ের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই! নতুন নতুন উপন্যাস কেন কেনা হচ্ছে না তার জন্য প্রায়ই তাঁদের তাগাদা শুনতে হতো। সায়ীদ স্যার রসিকতা করতেন তাঁদের নিয়ে। বলতেন এঁরা তো বই পড়েন না, ঘাাসকাটার মতো বইয়ের পাতা কেটে যান! এঁদের ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্য আমাদের নেই! আমরা তো কবিতা প্রবন্ধ ইতিহাস সমাজ দর্শন রাজনীতি বিষয়ের বইও সংগ্রহ রেখেছি—সেগুলোও তো পড়ার মানুষ থাকতে হবে! কিন্তু আমি তো ততদিনে অনুভব করতে শিখেছি বইপড়া কেবল একটি জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া নয়, বরং এক ধরনের আত্ম-অন্বেষণ, এক ধরনের সময়ভ্রমণ, এবং নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার অভ্যন্তরীণ মাধ্যম। ছোটবেলায়, বই পড়া আমার কাছে ছিল মধুর চেয়ে মিষ্টি, খেলনার চেয়ে আকর্ষণীয়, আর বাস্তবতার চেয়ে বেশি রঙিন। বই পড়তে পছন্দ করতাম নেশার মতো! তবে যত বড় হয়েছি, পড়া যেন হয়ে উঠেছে এক ধরনের চিন্তার অনুশীলন—কখনো প্রশ্ন, কখনো প্রতিফলন, কখনো নিজেকেই খুঁজে পাওয়া।
৪
মনে পড়ছে অল্প বয়সে পাঠ্যপুস্তকে পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধটি থেকে পাওয়া আমাদের উপমহাদেশীয় পাঠসংস্কৃতির খাঁটি চিত্রের কথা। তাঁর রসিক অথচ গভীর পর্যবেক্ষণ আমার নিজের পড়ার অভ্যাসের অনুশীলনে উদ্দীপ্ত করেছিল। তিনি যেমন বলেছেন, বইপড়া একটি ধাত, এটি একবার পেয়ে বসলে আর যায় না—আমি নিজেই যেন এর এক জীবন্ত প্রমাণ।
ফরাসি ভাষার লেখক মতেইনের (অনেকে ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে বলেন মনটেন) কথা সায়ীদ স্যারের কাছে তরুণ বয়সে শুনলেও বই পড়া নিয়ে তাঁর প্রবন্ধটি পড়া হয়েছে অনেক পরে। তিনি বলেছেন, সব বই সবার জন্য নয়। তিনি যে ব্যক্তিগত রুচির ভিত্তিতে বই পড়াকে উৎসাহ দেন, সেটি আমার পাঠ-জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মেলে। বহুবার এমন হয়েছে যেকোনো একটি বই আমার খুব ভালো লেগেছে, অথচ অন্যদের কাছে ততটা নয়। আবার, আমি যখন অন্যদের পছন্দের বই পড়ে হতাশ হয়েছি, তখন মতেইনের ওই সাবধানবাণী মনে পড়েছে : বই পড়া একটি একান্ত ব্যক্তিগত যাত্রা।
বই পড়া নিয়ে ফান্সিস বেকনের কথাও মনে করতে হবে। মনে হয়, মতেইনের তুলনায় ফ্রান্সিস বেকন বাংলাভাষার পাঠকদের কাছে বেশি পরিচিত। তাঁর প্রবন্ধ অনেকেই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আমিও ফ্রান্সিস বেকনের ‘এসে’-র সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সৈয়দ আবদুস সুলতানের বাংলা অনুবাদসূত্রে। তাঁর মতে, কিছু বই গিলে খেতে হয়, কিছু খেতে হয় চিবিয়ে, আর কিছু বইয়ের স্বাদ নিতে হয় শুধু। এই মেটাফোরটি আমার কাছে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পাঠভ্যাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৈশোরে গোগ্রাসে পড়েছি অ্যাডভেঞ্চারের বই, যৌবনে চিবিয়ে চিবিয়ে পড়েছি দর্শন আর সাহিত্যের তত্ত্ব, আর পরিণত বয়সে স্বাদ নিচ্ছি ধীরপাঠ্য, অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ লেখার।
বইপড়া নিয়ে ভার্জিনিয়া উলফের কথাও মনে রাখা জরুরি। তিনি বলেছেন, বই পড়ার জন্য চাই পাঠকের মুক্ত একটা মন। তাঁর মতে, বই পড়া যেন একটি সংলাপ—পাঠক ও লেখকের মধ্যকার এক নিঃশব্দ অথচ গভীর আলাপ বিনিময়। এ কথার সত্যতা আমি বুঝেছি তখন, যখন দিনের পর দিন আমি নিয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরির শরণ! আর বইয়ের পাতা ও লেখকের অন্তর্লীন কণ্ঠে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম মানবিক উষ্ণতা।
এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য আরেক ফরাসি লেখক মার্সেল প্রুস্তের কথাও। তিনি বলেছেন, বই আমাদের কল্পনার দরজা খুলে দেয়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে এই উপলব্ধি দিয়েছে যে, পড়া মানে কেবল অন্যের ভাবনাকে জানা নয়, বরং অন্যের সেই ভাবনাকে নিজের ভেতরে নতুন করে নির্মাণ করাও।
জার্মান ভাষার লেখক হারমান হেসে যে বইকে আত্মিক উন্নয়নের পথ হিসেবে দেখেছেন, তার সঙ্গেও আমি একমত। বহুবার এমন হয়েছে, কোনো একটি বই পড়ে আমি যেন নিজেকে নতুন করে চিনেছি, যেন এক ধরনের ভেতরদর্শনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
অন্যদিকে, রুশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক ভ্লাদিমির নবোকভ যে পড়াকে একটি সক্রিয় শিল্পানুভব হিসেবে দেখেছেন, সেটিও আমার পাঠকসত্তার সঙ্গে মিলে যায়। তাঁর মতে, ভালো পাঠক পড়ার মধ্য দিয়েই লেখকের কারুকাজকে উপলব্ধি করেন। আমি যখন কোনো লেখকের গদ্যের ছন্দ, বাক্যের গঠন, শব্দচয়নের পেছনের অভিপ্রায়কে ধরতে পারি, তখন পড়া যেন হয়ে ওঠে এক ধরনের সৃজনকর্মেই অংশগ্রহণ।
৫
আমেরিকায় বসবাস করতে এসেছিলাম ২০১৭ সালে। যে বাড়িতে উঠেছিলাম সে বাড়ির আগের মালিক জার্মান বংশোদ্ভূত নারী ইনগেবর্গ লাসটিং ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। তিনি স্থাবর অস্থাবর বেশ কিছু জিনিসপত্র রেখে গিয়েছিলেন যার মধ্য ছিল কিছু মূল্যবান বই, আর্থিক মূল্যের বিবেচনায় নয়, বিষয় ও লেখকের বিবেচনায় তাঁর বইসংগ্রহে সুরুচির পরিচয় পেয়েছিলাম। হয়তো তাঁর নিজের পেশাগত কারণে তাঁর পাঠরুচি আমার চাওয়ার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। তাঁর সংগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত হয়তো কখনো লিখে ফেলব। এখানে তাঁর সংগ্রহের একটা বইয়েই আপাতত সীমিত থাকছি। কারণ বই পড়া নিয়ে বড় বড় দার্শনিকের কিছু সূত্রের কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ে গেল ইনগেবর্গ লাস্টিংয়ের সংগ্রহের একটি বইয়ের কথা! প্রথম যখন তাঁর সংগ্রহের বই ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম তখনই চোখে পড়ায় আলাদা করে রেখেছিলাম সেটি। বইটির নাম হাউ টু রিড আ বুক। ইনগেবর্গ লাস্টিংয়ের কপিটি বেশ পুরোনো, বোর্ড বাঁধাই। কৌতূহল বশত অ্যামাজনে পরিভ্রমণ করতে করতে একই নামের একটি বই পেয়ে গেলে সেটিরও অর্ডার দিয়েছিলাম। অর্ডার দেয়ার সময় লেখকের নাম মিলিয়ে দেখা হয়নি। হাতে আসার পর খোঁজাখুঁজি করে লাস্টিংয়ের সংগ্রহের বইটা পেয়ে গেলাম। তখন তথ্য মিলিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম এর লেখক মর্টিমার জে. অ্যাডলার। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে। লাস্টিংয়ের কপিটিই সেই সংস্করণের। যেটা অ্যামাজনে অর্ডার দিয়েছিলাম সেটি এ বইয়ের পুনর্লিখিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। ইনগেবর্গ লাসটিংয়ের সংগ্রহের প্রথম সংস্করণের বোর্ড বাঁধাই কপিটি আমার কাছে রেখে অ্যামাজন থেকে সংগ্রহ করা কপিটি বইয়ের ইতিহাসে আগ্রহী অনুজপ্রতিম বন্ধু কুতুব আজাদকে উপহার দিয়ে ফেলায় হাতের কাছে নেই। ওই কপিটিও ছিল কারো দ্বারা আগে ব্যবহৃত একটি পেপারব্যাক সংস্করণ। এটি মর্টিমার জে. অ্যাডলার এবং চার্লস ভ্যান ডরেনের পুনর্লিখিত যৌথ রচনা। ব্লার্বে বলা আছে, পড়ার শিল্প নিয়ে এটি ‘একটি প্রভাবশালী বই’। প্রথম সংস্করণের উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের পড়ার শিল্প শেখানো; বিশেষ করে উদ্দেশ্য ছিল ‘গ্রেট বুকস’ পড়ার উপযুক্ত পদ্ধতি বোঝানো।
পরে, ১৯৭২ সালে, চার্লস ভ্যান ডরেনের সহ-লেখকতায় বইটির একটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্লিখিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইপ্রেমী কুতুব আজাদকে দেয়ার আগে উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে মনে হলো এখন আবারও এক কপি কিনতে হবে নিজের জন্য। কারণ দ্বিতীয় সংস্করণটি বেশি প্রাঞ্জল ও উপযোগী। এই সংস্করণে পঠন স্তরগুলোর ব্যাখ্যা আরও উন্নত করা হয়েছে, নতুন অধ্যায় যোগ করা হয়েছে এবং যোগ হয়েছে কিছু ব্যুৎপত্তিগত ও দার্শনিক বিশ্লেষণ। এটা নতুন যুক্ত হওয়া লেখক চার্লস ভ্যান ডরেনের অবদান।
৬
এই বইটি যেকোনো ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো সমালোচনামূলকভাবে পড়ার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়। আগে মতেইন, বেকন, উলফ, জিদ, হেসে বা নবোকভ থেকে আমরা যে দার্শনিক পথনির্দেশ পেয়েছি এই বইটি যেন তারই ব্যবহারিক অনুশীলনের উপায় শেখায়! বইপড়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেছে এই বই : একটি পর্যবেক্ষণমূলক (inspectional) এবং অন্যটি বিশ্লেষণমূলক (analytical)। পর্যবেক্ষণমূলক পড়া বলতে বোঝানো হয়েছে ভূমিকা ও সূচিকে দ্রুত স্ক্যান করা—যার মাধ্যমে একটি বইয়ের মূল ধারণাগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে চিহ্নিত করা যায়। আর, বিশ্লেষণমূলক পড়ায় পাঠককে শেখায় বইটি কীভাবে শ্রেণিবদ্ধ করতে হয়, কীভাবে নির্ধারণ করতে হয় এর কাঠামো এবং ব্যাখ্যা করতে হয় লেখকের যুক্তি ও প্রধান শব্দগুলোকে।
গুগল করে দেখলাম এরই মধ্যে বইটির অনেকগুলো সংস্করণ হয়েছে, কয়েকবার বদল হয়েছে প্রচ্ছদ এবং বিক্রি হয়েছে পাঁচ মিলিয়ন কপিরও বেশি। সাধারণ পাঠকের পাঠবোধ্যতা বৃদ্ধির জন্য ৮০ বছর ধরে এই বইটি যে সফল ও নির্ভরযোগ্য একটি গাইড বইয়ের দায়িত্ব পালন করে চলেছে তা বললে হয়তো অতিকথন হবে না। দ্বিতীয় সংস্করণে সহ-লেখকের সহযোগিতায় বইটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে লেখা হয়েছে এবং এতে নতুন যোগ করা হয়েছে অনেক কিছু। বইটি পাঠকদের চারটি স্তরে পাঠপদ্ধতি আয়ত্ত করতে শেখায়। ‘বই পড়া’কে উপস্থাপন করে একটি সক্রিয় ও বিশ্লেষণমূলক বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ হিসেবে।
বইয়ের প্রথমভাগের শিরোনাম : The Dimensions of Reading। এই ভাগের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে The Activity and Art of Reading। এখানে বলা হয়েছে, বই পড়া একটি সক্রিয় কাজ, কেবল চোখ বুলিয়ে যাওয়া নয়। একটি ভালো বই পড়া মানে লেখকের চিন্তার স্তরে পৌঁছানো। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম : The Levels of Reading। এখানে আবার পাঠকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এক. প্রাথমিক পঠন, দুই. পর্যবেক্ষণমূলক পঠন, তিন. বিশ্লেষণমূলক পঠন এবং চার. সিনটপিক্যাল বা তুলনামূলক পঠন।
দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম : The Third Level of Reading: Analytical Reading। এর অধ্যায়গুলোতে বিশ্লেষণমূলক পাঠ কীভাবে করতে হয়, তা শেখায়। এতে বলা হয় বইয়ের মূল গঠন সম্পর্কে (Structure) বোঝার কথা। লেখকের উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করা তথা বইয়ের মূল ধারণা ও যুক্তিকে শনাক্ত করা এবং লেখকের সঙ্গে যুক্তিবহ বিতর্কে প্রবেশ করা। একে লেখক বলেছেন Critically Agree or Disagree করা।
তৃতীয় ভাগের শিরোনাম : Approaches to Different Kinds of Reading Matter। পাঠ্যবস্তুর ধরনভেদে পাঠপদ্ধতির রূপ কেমন হওয়া উচিত, তা আলোচনা করা হয়েছে এখানে। ইতিহাসের বই, বিজ্ঞানের বই পড়বার কী কী পদ্ধতি আছে, আলোচনা করা হয়েছে তা নিয়ে।
ভালো পাঠক হতে হলে আরও আছে ক্ল্যাসিক হিসেবে পড়া-থাকা জরুরি এমন একটা বইয়ের তালিকা। বাঙালি পাঠকের কাছে হয়তো তালিকাটি সম্পূরক হয়ে উঠতে চাইবে! বেশ লম্বা একটা তালিকা দেয়া আছে এখানে নিঃসন্দেহে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তালিকা দেখে বাংলাভাষার পাঠকেরা হয়তো কিছু বইয়ের নাম আরও যোগ করতে চাইবেন!
৭
আমার লেখাটা হয়তো পুরোপুরি ওই বইয়ে সীমিত থাকল না। কারণ এর জন্য বইটা গভীর গভীরতরভাবে পড়তে হবে। তাই লেখাটা শেষ করতে হলো এইভাবে যে, বইটা আমার ঠিকমতো পড়া হয়ে ওঠে নাই। হয়তো How to Read a Book বইটি কোনো দিন এই বইয়ের নির্দেশনা অনুসারে পড়া হয়ে উঠতে পারলে বইটা সম্পর্কে একসময় ভালোভাবে লিখে উঠতেও পারব!
সব মিলিয়ে, বইপড়া আমার কাছে কোনো একক অভিজ্ঞতা নয়, বরং একেক সময়ে একেক রূপে ধরা দিয়েছে। কখনো প্রেম, প্রতিবাদ, প্রশান্তি, প্রেরণা হয়ে অথবা এসেছে পরিত্রাণ হয়ে। আমি যেভাবে একজন লেখক হয়ে উঠতে চেষ্টা করছি, তার রক্তমজ্জায় মিশে আছে পড়ার এইসব প্রক্রিয়া। আর তাই, যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে—কেন পড়ি? তখন হয়তো এক কথায় জবাব দিতে পারি : ‘বই পড়ি এই বিশ্বচরাচরকে নিজের বোধের আতশকাচে উত্তীর্ণ করে তার মধ্য দিয়ে জানবার জন্য।’
আহমাদ মাযহার প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। মৌলিক রচনাসহ অনূদিত সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের অধিক। বইয়ের জগৎ নামে বই-সমালোচনা বিষয়ক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করেছেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বসবাস করেন।