লাঠির রং


বাড়িতে মিস্তিরি একবার লাগালে আর নিস্তার নেই। বিশেষ করে কাজটা যদি হয় বসবাস চলাকালীন রং ফেরানোর। কী যে তাদের কখন লাগবে তার কোনো ঠিক নেই। দড়ি, বালতি, ছেঁড়া ন্যাকড়া, ছুরি, দা, এইসব বিচিত্র বস্তু চাওয়া হয়ে গেছে। আমি প্রমাদ গুনছি। ভাবছি আর কী চাইতে পারে। আমাদের বাড়িটা আবার পঞ্চাশ বছরের পুরোনো। জায়গায় জায়গায় ড্যাম্পের ছোপ। রং করবার আগে প্লাস্টার চেক করাটা অবশ্য কর্তব্য। তখন দেখা যাবে কোথাও না কোথাও পুরোনো প্লাস্টার ফেলে দিয়ে নতুন করে লাগাতে হচ্ছে। ওমনি হয়তো ওরা চাইবে বালি মিহি করে চালবার জন্য একটা চালুনি। সেই চালুনি ভাড়া করে আনতে একজন অগস্ত্য যাত্রায় চলে যাবে আর বাকিরা বসে যাবে বিড়ি খেতে। অপেক্ষমানদের কেউ কেউ গিন্নীর কাছে আবদার জানাবে,
‘বৌদি, এট্টু চা বসান দিনি।’

মিস্তিরিরা বেশিরভাগই মুসলমান। আমাদের টাউনের বাড়ির পেছনে, ছিনাথপুরের বাসিন্দা। আমরা, হিন্দু পাড়ার উঁচু জাত। ছোট বয়স থেকেই এদের চিনি, তাই বাড়ির কাপে চা দিতে আমরা অপারগ। তখন ওদের আরেকজন চলে যাবে কাগজের কাপ কিনতে। চালুনি নিয়ে প্রথমজন ফিরলে তৃতীয়জন যেতে চাইবে দ্বিতীয়জনকে খুঁজে আনতে। কারণ চা হয়ে গেছে কিন্তু কাপ আসেনি; ঠান্ডা মেরে যাবে। সেইজন্য আমার বাবা সব সময় মিস্ত্রি লাগানোর আগের দিন হেডমিস্তিরির সঙ্গে কথা বলে কড়ার করিয়ে নিতেন, দিনে দু-কাপ চা এবং চারটে করে বিড়ি টেনে সবাই কাজ করতে রাজি কি না। তারপর ছাতা মাথায় দিয়ে সারাদিন বালি সিমেন্টের সঙ্গে সজাগ হিসেব রাখতেন চা এবং বিড়ির। মাটির খুরি আগের দিন গুনেগেঁথে কিনে এনে রাখত। 

মিস্তিরিদের যাবতীয় আবদার এবং দাবির স্তর পার করে ফেলেছি আমরা। তিনচার রকমের রং এসেছে। কার্নিশ, দেওয়াল, পাঁচিল, সানসেট, সব আলাদা আলাদা কালারের হবে। ভেতরের রং শেষ। এইবার বাইরের দেওয়ালে ফার্স্ট কোট হোয়াইট ওয়াশ মারা হবে। চুন, চালুনি, তুলি, সব এসে গেছে। জল ঢালবার আগেই একটা লাঠি চাইল হেডমিস্তিরি। যেন মজবুত হয় আর অন্তত ফুট চারেক লম্বা হয় লাঠিটা। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কোথায় পাই এইরকম লাঠি এখন। বাড়ির কাজের সরঞ্জাম ভাড়া দেয় আমাদের বাড়ির কাছের একটা দোকান। ছুটলাম সেখানে। কিন্তু সে বলল,
‘কাকা, কী হবে লাঠি দিয়ে?’
বললাম,
‘চুনটা ব্যারেলে ঢেলে নিয়েছে। এইবার জল ঢেলে লাঠি দিয়ে ঘুঁটবে।’
‘ক্যানেস্তারায় ঢালেনি কেন? তাহলে তুলি দিয়েই নেড়ে নিত।’
‘আমিই বলেছি ব্যারেলে গুলতে। একবারে অনেকটা গুলে নিলে তাড়াতাড়ি কাজটা এগোবে। নইলে বারবার গুলতে বসবে আর বাকিরা বিড়ি খাবে।’
বাবার জিন আমার ভেতর সক্রিয় হয়ে উঠেছে টের পাচ্ছি। দোকানি বলল,
‘তাহলে এখন লাঠি বানাতে দিন। ওরকম লাঠি আমার নেই। মিস্তিরির ফাঁকি আপনি ঠেকাতে পারবেন ভেবেছেন? বাঘা বাঘা প্রোমোটাররা পারে না…।’
বাড়ি থেকে গিন্নির মেজাজি ফোন,

‘এই যে, আসুন। লাঠি পেয়েছি। আগে আপনাকে দু চার ঘা দেব। তারপর ওদের হাতে দেব।’
ঢুকেই দেখি লাঠিটা বারান্দার এক কোণে হেলান দিয়ে রাখা। পাক্কা খাঁকি পোশাক পরা সরকারি লাঠিয়ালদের হাতের লাঠির মতো তার শরীর। ওটা দিয়ে ছোটখাটো ভিড়কে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করা যায়। দেখামাত্র বুকের ভেতরটা উথাল পাথাল করে উঠল। ভুলেই গিয়েছিলাম ওকে। আর ভুলেরই বা দোষ কী। হিসেব কষলে লাঠিটার বয়স তো আজ পঁচাত্তর বছর। ওর মালিক বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো পাক্কা একশো। ভুলতে বসেছি সেই মালিককেও। মৃত্যুর তারিখটুকুও মনে পড়ে না, এতোই বেইমান হয়ে গেছি আমি!

ঠিক কেমন ছিল লাঠিটার অতীত? 
এই লাঠিটার গল্প, আসলে লাঠিটার ইতিহাস, আমার বাবাও সবটা দেখেননি। না-দেখা অংশটা শুনেছেন আমার নিজের মায়ের বাবা, কৈলাশ চক্রবর্তীর কাছে। আর বাকিটা বাবার জীবনের অংশ। বাবা আজ তেইশ বছর হল, নেই। 

আমি লাঠিটাকে জ্ঞানত দেখছি তিন-চার বছর বয়স থেকে। পরিচয়ের শুরু থেকে, কাশীর অলিতে গলিতে, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে, মন্দিরে মন্দিরে, আমি ওকে দেখেছি দাদুর হাতে। দাদু ভোরবেলা, এমনকী কাশীর কাঁকড়া-কামড় শীতেও, আমার যাবতীয় অনিচ্ছাকে তুচ্ছ করে ঠেলে তুলেছেন বিছানা থেকে। পায়নি তবু জোর করে পাঠিয়েছেন বাহ্যে ত্যাগ করতে। তিনতলার ছাদের কোণে, সেই ছোট্ট বাহ্যে-কক্ষে ঢুকে, অভিমানে রাগে ক্রোধে অধীর হয়ে, আমিও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়েছি শেকল। দাদু ছাদের ওপর ল্যাঙট পরে মুগুর ভেঁজে ঘাম ঝরানো সেরে, অঙ্কুরিত ভিজে ছোলা, আদা, আখের গুড় দিয়ে সেবন শেষ করেও দেখছেন, নাতি বেরোচ্ছে না। তিনি হুংকার ছাড়ছেন,
‘বাইরায়, বাইরায় হারামজাদা। হেই দুষ্টঅ, আয় বাইরা।’

আমি বেরোচ্ছি না। গোঁজ হয়ে পাদানি দুটোর ওপর বসে খালি গায়ে কাঁপছি। দাদু দু একবার শাল কাঠের খড়মের একটা পাটি দিয়ে ছাদ পেটাচ্ছেন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, না বেরোলে ওই খড়ম আমার পিঠে ছাদ পেটাবে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা।
এইসব সময়ে সদ্য মাতৃহারা নাতিটির শেষ ভরসা আর কে হতে পারতো, দিদা ছাড়া?
ছলছুতো করে দাদুকে নিচে ডেকে নিয়ে, একটা যেকোনো কাজ ধরিয়ে দিয়ে, ফের তিনতলায় উঠে এসে বলতেন,
‘ওরে, বাইরায়। তর দাদুরে নিচে নামায় নিসি। জিগাইলে তুই কবি তোর বাহ্যে কিলিয়ার। পাছায় একটু জল বুলাইয়া নাম।’
কিন্তু মর্নিং ওয়াক থেকে নিস্তার তো চাইলেই পাওয়া যায় না। নিচে এসে, আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলা আর কাঁচা বাদাম, সঙ্গে নুন মাখানো আদার কুচি আর আখের গুড়, যার প্রতিটি গ্রাস সেই বালকের কাছে অখাদ্য, সেটা গিলে, সোয়েটার, মাফলার, মাংকিক্যাপ শোভিত হয়ে সে দেখত, দাদু, মানে কৈলাশ চক্রবর্তী, পায়ে কেডস, পরনে ধুতি ও মাথাটি তুষের চাদর দিয়ে আবৃত, হাতে সাড়ে চারফুট উঁচু সেই মজবুত লাঠিটা হাতে নিয়ে রেডি।
এইবার হনহনিয়ে হাঁটো পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে সোনারপুরা থেকে সঙ্কটমোচন মন্দির। দাদুর হাতের মুঠোয় ধরা লাঠির ডগা। গোড়াটা উঠছে নামছে পাথর বাঁধানো গলি ধরে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে। চলার গতি ও ভঙ্গিতে কৈলাশ চক্কোত্তি তখন ডাণ্ডি মার্চের গান্ধীকেও হার মানাচ্ছেন। তাঁর খেয়াল নেই পাঁচ বছরের নাতিটি দৌড়েও তাল রাখতে পারছে না।

সংকটমোচন মন্দির এলে সংকট কিছুটা মোচন হত। একপাক মেরে, প্রণাম সেরে মন্দিরের চাতালে বসার অনুমতি পাওয়া যেত। বসেও রেহাই নেই। তখন চলত গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ করবার পালা। দুজনারই উচ্চগ্রামে প্রতিযোগীতা মূলক ভাবে গলা ছাড়া শুরু,
ঔং ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেন্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধী…।
আর কী আশ্চর্য! ওই মন্ত্র শুনলেই পিলপিল করে লাল রঙের মুখ ও পশ্চাদ্দেশ বিশিষ্ট বাঁদরের পাল এসে ঘিরে ধরত নাতিসহ দাদুটিকে। দাদু তৈরি থাকতেন। লাঠি বাগিয়ে শাসন করে একটু দূরত্ব রেখে বসতে দিতেন লাঙ্গুলধারীদের আর ফতুয়ার পকেট থেকে কাঁচা ছোলার দানা বার করে তাদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতেন। মুখে বলতেন,
‘তর আর এই বান্দরগুলার মধ্যে তফাৎ খুবি সামাইন্য। ওদের লাঙ্গুল আসে, তর নাই।’
হা ক্লান্ত অবস্থায় তারপর ফেরার পালা। এইবার একে একে অসি ঘাট, তুলসি ঘাট, চৈত সিং ঘাট, শিবালয় ঘাট পার হয়ে আবার এসে পৌঁছন সেই কেদার ঘাটে। পাথর বাঁধান চাতালে আগে লাঠিটা শোবে। দাদু মাখবেন একটা ছোট্ট কাচের শিশিতে বাজারের ব্যাগের এক কোণায় করে নিয়ে আসা খাঁটি জ্বালাময়ী সর্ষের তেল। সোয়েটার, ফতুয়া, ধুতি, চাদর, সব পাথরের চাতালে লুটিয়ে রইবে, পরনে থাকবে শুধু সেই ল্যাঙট। নাকের ফুটো, কানের ফুটো, নাভিদেশে, গুহ্যদেশে কখনো দু আঙুলে, কখনো কনিষ্ঠায় করে, সেই তেল, টেনে ও গুঁজে দিয়ে তারপর এক ঝাঁপ মা গঙ্গার বুকে। ততক্ষণ নাতি থাকবে লাঠির পাহারায়। দাদু, এক সাঁতারে হাফ গঙ্গা পার হয়ে আবার তীরে ফিরে আসবে এবং বুকজলে দাঁড়িয়ে পুবপাড়ের রামনগরের রাজবাড়ির ছাদের ওপর উদিয়মান সূর্যের দিকে মুখ করে চিৎকার করে বলবে,
‘অউম, জবাকুসুমও শঙ্কাসং, কাশ্যপেয় মহাদ্যুতিম…।’ 

আমি তখন সিঁড়িতে বসে মায়ের কথা ভাবতাম। তিন বছর বয়সে কোনো শিশুর মাতৃ-স্মৃতি তৈরি হয় না। তখন আমার পাঁচ চলছে। মাতৃস্মৃতির জায়গাটা একদম খালি, শূন্য। বছর পাঁচেক বয়েস থেকে মহিলা মহলের ফিসফিসানির ভেতর শুনেছি মা সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে চলে গেছে মহাপুণ্যবতী বলেই। কল্পনায় সেই সিঁদুর দাদুর স্নানের সময় কেদারঘাটের সিঁড়ির নিচ থেকে গঙ্গার জলে মাখামাখি হয়ে ওপারের রামনগরের ঘাট অবধি একটা টানা সিঁথির মতো দুলতো। ঢেউয়ের তালে তালে সেই সিঁথি কোথাও ভাঙ্গতো, কোথাও জুড়তো। আর সেই ভাঙা জোড়ার খেলার মাঝখান দিয়ে ভেসে যেত বেলপাতা, জবা আর গাঁদাফুলের মালার দল।

সূর্য প্রণাম শেষ হলে পরবর্তী কাজ হলো এই ‘বান্দর’-কে নিয়ে জলে চোবান এবং সাঁতার শেখানোর বৃথা প্রয়াস। জলে এতো ভয় আমার ছিল যে চিল চিৎকার জুড়ে দিতাম নেমেই। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের ধস্তাধস্তি সেরে দাদু কেদারঘাট ত্যাগ করত।
বাড়ি এসে ডাল ভাত মাছভাজা খেয়ে ‘কাশী হিন্দু হাইস্কুল’-এর চত্বরে আমার শিক্ষা শুরু ততদিনে হয়ে গিয়েছিল, মাতৃভাষায় নয়, হিন্দিতে। কোনো মতে ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর বাবা, আমাকে বান্দর থেকে মানুষ তৈরি করবে বলে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, সপরিবারে চলে এলো রানাঘাট টাউনে, ছোট্ট একটা ভাড়ার এক কামরার ঘরে। সঙ্গে নতুন মা।

সেই দাদু, আমি ক্লাস ইলেভেনে, চলে গেলেন ক্যান্সারে। ততদিনে আমরা টাউনের নতুন তৈরি বাড়িটায় চলে এসেছি, তাও প্রায় বছর পাঁচ-ছ বছর হলো। হিন্দির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাংলা মাধ্যমের ক্লাস ফোরে ঢুকে টুকটুক করে ক্লাসগুলো টপকাতে টপকাতে ক্রমে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে সবে কিছু বখাটে বন্ধুসঙ্গে বিড়ি সিগারেট এবং গাঁজায় হাতেখড়ি দিচ্ছি, ঠিক সেই সময় দাদু চলে গেল। ক্লাস টু-তেই দাদু বুঝতে পেরেছিলেন যে আমাকে মানুষ করা সম্ভব নয়। দিদার প্রশ্রয়ই নাকি আমার মানুষ হওয়ার পথে প্রধান বাধা। তাই জামাইয়ের দ্বিতীয় বিবাহ দিতেই হবে। বেনারসের অসহায় বিধবা মহল্লা চষে ফেলে উনি পেয়েও গিয়েছিলেন একটি উপযুক্ত মেয়ে। ব্রাহ্মণ এবং দরিদ্র। সেই মেয়ের মা একদম সর্ব অর্থে কাশীর বিধবা। আত্মীয় পরিজন কর্তৃক পরিত্যাক্তা, সহায় সম্বলহীনা, একটি মাত্র অরক্ষণীয়া যুবতী কন্যার মা। সামান্য কিছু সরকারি অনুদান পান এবং পাঁচ টাকা মাসিক ভাড়ায় ভেলুপুরায় একটি প্রায়ান্ধকার ঘরে থাকেন। মেয়েটি ক্লাস ফোরের পর পড়াশোনা করবার আর্থিক সামর্থ্য হারিয়েছে। তখন সেলাই ফোঁড়াই করে মাকে যৎকিঞ্চিত সাহায্য করছিল। প্রশ্ন উঠল খুব স্বাভাবিক ভাবেই, যে-জামাইয়ের প্রথম স্ত্রী বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট, শান্তিনিকেতন থেকে নন্দলাল বসুর কাছে ইন্ডিয়ান আর্ট নিয়ে পাশ, তারপর নদীয়া জেলার এক বিডিও অফিসের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিল, সেই জামাই কেন এই বিধবার ক্লাস ফোর পাশ মেয়ের পাণি।  গ্রহণ করবে?

কিন্তু না, দেখা গেল, এই ব্যাপারে শ্বশুর জামাই এক মত। বড় হয়ে, সাংসারিক জ্ঞানগম্যি হলে, নতুন মা এই রহস্য আমার সামনে উদ্ঘটন করে দেয়। সে কথা ক্রমশ জানাবো। 
বাবা ছিলেন ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারের চতুর্থ সন্তান। অতি সুদর্শন, ফর্সা, দীর্ঘ, ধরাল চেহারা এবং বুদ্ধির অধিকারী। কিন্তু প্রথম স্ত্রী তার পছন্দের ছিল না। কেন? আমার বিবাহের সময় সেটা বুঝতে পারি। আমার চাকরিতে তখন সামান্য মাইনে। তাই চাকরিজীবী মেয়ে বিবাহ করব শুনে বাবার মুখ ভার। অনেক লড়াই করে বাবাকে রাজি করাতে হয়েছিল।

 বাবাকে আমি প্রায়ই জিগ্যেস করতাম,
‘আচ্ছা বাবা, তুমি বীরনগরের, নদীয়া জেলার লোক। দাদু কাশীর। মা শান্তিনিকেতনের। তাহলে আমরা সবাই এক জায়গায় হলাম কী করে?’
বাবা খুব একটা আমার প্রথম মায়ের কথা বলতে চাইতেন না। আমি নতুন মায়ের কাছ থেকে সেই রহস্যের ইতিহাস উদ্ধার করি। নতুন মা আমাকে বলেছিল,
‘অনেকটা সিনেমার মতো রে সে সব কাণ্ড।’
‘আমাকে বল, বল না মা।’

‘শোন তবে। তোর দাদু, কৈলাশ চক্কোত্তি ছিলেন কাঠ বাঙাল। অসম্ভব তেজিয়াল আর সৎ। সামান্য জমিদারি ছিল ঠিকই কিন্তু খাজনা বা ফসল আদায়ে মন ছিল না। ওনার দিন কাটত যজমানি করে। একটা মাত্র মেয়ে। কী হবে এইসব প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে, এই ছিল তার মনের ভাব। বহু লোকের খাজনা মকুব করে দিতেন একবার এসে কেঁদে পড়লেই। কিন্তু বাকি ভাইরা শুনবে কেন? তারা বলে দিল পার্টিশানের পরও আমরা এখানেই থাকব। তুমি যাচ্ছ যাও, সম্পত্তি সব আমাদের নামে সই করে দিয়ে তবে যাও।’

নতুন মা ভীষণ কাঁদতে ভালোবাসত। এই কথাকটা বলতে গিয়ে কেঁদেকেটে একশা হতো। তারপর নাক চোখ আঁচলে মুছে বলল,
‘উনি তো ভয়ানক রেগে গেলেন। ঘরের চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এই আমি বৌ মেয়ে নিয়ে এক বস্ত্রে এখুনি চললাম। একটা ফুটো পয়সাও নিয়ে যাব না এজমালি থেকে, আর লিখে দিয়েও যাব না। মর তোরা বুকে সম্পত্তি নিয়ে। বাকি ভাইয়েরা এমন শয়তান, বলল কী, একবস্ত্রে যেটা বলছ, সেটাও তো এজমালি থেকেই কেনা। উত্তরে তোর দাদু বললেন, মোটেই না। আমার বউয়ের শাড়ি, মেয়ের ফ্রক আর আমার ধুতি খড়ম, সব যজমানির টাকায়। আর সব থাকবে। আমি কেবল এইটা নিয়ে যাব। রাস্তায় বিপদ আপদ হলে আর আমাকে দেখবে কে? এই বলে ঘরের কোণা থেকে ওই লাঠিটা তুলে নিয়ে বার হয়ে এলেন।’
মা আবার কাঁদো কাঁদো। আমি বলেছিলাম,
‘মা, আর মাঝখানে কেঁদ না। বাকিটা বল, তারপর কাঁদ।’
‘তোর দাদু ঠিক করেই রেখেছিল কাশীবাসী হবেন। সেইদিনই বৌ মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে, নানা ঘাটের জল খেতে খেতে অবশেষে এসে ঠিক উঠলেন কাশীর কেদার ঘাটে। এসেই বসে গেলেন অজগর ব্রত করতে।’
‘অজগর ব্রত? সেটা আবার কী?’

মা ভাত মেখে মুখে তুলে দিতে দিতে বাকিটা আবার শুরু করত,
‘অজগর কখনো খাবারের পেছনে ছোটে না। খাবার মুখের কাছে এলে তবেই খায়। তোর দাদুও ঘাটের সিঁড়িতে এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল আর পায়ের কাছে বসল তোর দিদা আর মাথার কাছে তোর মা।’
আমি ভাত চিবোতে ভুলে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলেছিলাম,
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? দিনের শেষে দেখা গেল চারিদিকে ভক্তরা জোড়হাতে ভিড় করে বসে। হবে না? গায়ে ধবধবে পইতে। ন্যাড়া মাথায় ইয়া বড় টিকি। নাকে রসকলি। গলায় কণ্ঠি। ওপর হাতে রুদ্রাক্ষর প্যাঁচানো মালা। ছ ফুট লম্বা পেটাই শরীর। গায়ের রঙটা কালো ঠিকই, কিন্তু ব্রহ্মতেজ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। আর চারিদিকে নামিয়ে রাখা আছে সিধে, কাঁড়ি কাঁড়ি ফলমূল, দৈ চিঁড়ে মিষ্টি। তোর দাদু চোখ খুলতেই জয় ভোলেনাথ, মহারাজজী কি জ্জয়, বলে লোকজন জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। প্রণামের পর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখতে লাগল সিকি আধুলি টাকা। তাদের ভেতরেই এক বাঙালি বৃদ্ধ, ভিড় ফাঁকা হলে কাছে এসে প্রণাম করে সব শুনলেন। তারপর হাত জোড় করে বললেন, আপনি রোজ বিকেলে এখানে এসে বসবেন। আর রাতে থাকবেন আমার বাড়ি। আমি আপনার কাছে দীক্ষা নেব। আমার তিনকুলে কেউ নেই। কিন্তু একটা বাড়ি আছে এই ঘাটের ওপরেই, কুমারস্বামী মঠটা ছাড়িয়ে বাঁ হাতি গলিতে। আপনি একদম ওপরের তলায় থাকবেন, সপরিবারে। দোতলায় আমি থাকি একটা ঘরে আর বাকি ঘরগুলোয় কিছু সহায়সম্বলহীন বিধবা সামান্য ভাড়ায় থাকেন। আপনি চলুন। সঙ্কোচ করবেন না। এই যুবতী মেয়েকে নিয়ে এইভাবে সন্ধের পর ঘাটে বসে থাকা নিরাপদ নয়।
‘দাদু শুনে কী করল?’
‘তোর দাদু রাজি হয়ে গেল। গিয়ে উঠল সেই বাড়িতে।’
‘তাহলে কাশীর বাড়িটা দাদুর নিজের নয়?’
‘আরে শোন সবটা। সেই লোক মরবার আগে ওই বাড়ি দাদুর মেয়ে মানে তোর মায়ের নামে লিখে দিয়ে গেল। খুব করেছিল তোর মা আর দিদা ওই লোকটার শেষ জীবনে রে। উনার তো কেউ ছিল না আর।’
‘কিন্তু তোমাকে বাবা বিয়ে করল কেন? শুনেছি মা চাকরি করত। অনেক লেখাপড়া জানত। ছবি আঁকতে পারত।’
মা দেওয়ালে টাঙান আমার মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত,
‘আর সুন্দরীও ছিলেন ভীষণ। আমি তো মোটা আর কালো। তোর মাকে দেখলে নাকি কেউ চোখ ফেরাতে পারত না। আমি অবশ্য দিদিকে দেখিনি। শুধু ফটোতে দেখেছি। পরে তোদের গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে শুনেছি। গ্রামের লোকেরা তো তোর মা বলতে আজও অজ্ঞান। বলে সে নাকি ছিল সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা।’
‘কেন? দুর্গা কেন?’
‘দুর্গাই ছিল রে তোর মা। দুর্গতিনাশিনী একদম। বিপদে কেউ পড়েছে শুনলেই ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়ত। ম্যালেরিয়া আর বসন্তের তখন খুব দাপট তোদের দেশের গাঁয়ে। সেই সময় রুগীদের ঘরের একদম ভেতরে ঢুকে গিয়ে দেখভাল করত। ভয়ে তখন ডাক্তাররা পালাচ্ছে। তোর মা কিন্তু ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। অফিসার ছিল তো ওয়েলফেয়ার দপ্তরের। ডিউটিতে কোন ফাঁকি ছিল না।’
‘মা নাকি আমার পরের ভাই হতে গিয়ে মারা যায়?’
নতুন মা শুনেই চোখ থেকে তোড়ে ছেড়ে দিয়েছিল। কান্না সামলে ধরা গলায় বলেছিল,
‘তাইই তো। হার্ট খারাপ হয়ে গিয়েছিল খাটুনির চোটে। সময় মতো খেতে ঘুমতে টাইম পেত না। তুই তো সিজারের বেবি। মাত্র তিন বছরের। তার ওপর আবার পেটে আরেকটা বাচ্চা টানার ধকল। নিতে পারেনি রে।এখন ইস্কুলের টাইম হয়ে গেছে। যা। ওঠ। রাতে বলব ’
রাতে ভাত পেটে পড়লেই এতো ঘুম পেয়ে যেত যে শোনা হতো না দিনের পর দিন। আরেকদিন খাওয়ার সময় জানতে চাইলাম ওই পুরোনো প্রশ্নটার উত্তর,
‘কেন তোমাকে বিয়ে করল বাবা? মা ছিল চাকরি করা মেয়ে। আর তুমি তো কিছুই করতে না।’
নতুন মা একটা কুয়াশা ঢাকা ঝাপসা জবাব দিত,

‘আসলে তোর মায়ের ছিল সারাদিন অফিস আর অফিস। এই রাশিয়া থেকে, এই জার্মানি থেকে তখন নানা রকম সাহায্য আসছে। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে তো। তোর মায়ের ডিউটি ছিল ওইসব সাহায্য, রিলিফের টাকাপয়সা গরিব রিফিউজিদের মধ্যে সরকারি নিয়ম মেনে বিলি করে দেওয়া। আর তুই ছিলি ভীষণ দুষ্টু, পাজি, জেদি আর একগুঁয়ে। যাই হোক, আমাকে তোর দাদু বিয়ের আগেই সব খুলে বলেছিল। লাঠিটা দেখিয়ে বলেছিল তোকে ওই লাঠিটার ডগায় রাখতে। নইলে তুই বান্দর হয়া যাবি। আর বলেছিল তোর বাবাকে একটু যত্নআত্তি করতে। তোর বাবারও তো বাবা মা দুজনাই পক্সে মরেছে। তারপর থেকে ভাইতে ভাইতে শরীকী মামলায় জেরবার। আর আমার মা কেমন গরিব তুই তো জানিস। দুবেলা ভাত জুটত না আমাদের। তোর বাবা সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ হয়ে এসে উদ্ধার করেছে আমাদের।’
বলতে বলতে নতুন মা আবার কান্নার স্রোতে ভেসে যেত।

বাবার প্রথম বিয়ের পরপর, বিয়েতে পাওয়া লটবহরের সঙ্গে, সেই প্রথম, লাঠিখানা চলে আসে আমাদের নদীয়ার বীরনগর গ্রামে। সঙ্গে আসেন কৈলাশ চক্কোত্তি নিজে, আমার দিদা ও সদ্য বিবাহিতা আমার প্রথম মা। তখনো পূর্ব পাকিস্তান থেকে টুকটাক করে রিফিউজিরা আসছে। বিশেষ করে চলে আসছে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের গরিব মানুষগুলো। আমাদের গ্রামের বাড়িটা আবার রেল স্টেশন থেকে তিন মাইল দূরে, পাহাড়পুর নামে এক গ্রামের ভেতরে। যাকে বলে অজপাড়াগাঁ। বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা গেল নতুন বৌ গাঁয়ের পথে নেমে পড়েছে। কারও বাড়ি পক্স হলে সেখানে গিয়ে ধূপ ধুনো দিচ্ছে। খাবার জল দিচ্ছে আত্মীয় স্বজন ছেড়ে যাওয়া একা পড়ে থাকা রুগীদের বিছানার কাছে গিয়ে গিয়ে। বাবা খুব রাগ করছে আর দাদু মাকে উৎসাহ দিতে নিজেও বেরিয়ে পড়ছে লাঠিখানা হাতে করে। রুগীর ঘর ফাঁকা পেলেই তো শেয়াল ঢুকছে, রুগীটা কখন মরবে, আর ও খাবে বলে। দাদু শেয়াল দেখলেই লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছে মেয়ের পিছু পিছু। 

মায়ের এই কাণ্ডকারখানার গল্প দাবানলের মতো ছড়াতে ছড়াতে গিয়ে উঠল এলাকার বিডিওর কানে। সাহেব, মাকে আর দাদুকে নিজের গাড়ি পাঠিয়ে চেম্বারে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাতজোড় করে আবেদন করে রাজি করিয়ে একটা কাগজে চাকরির জন্য এ্যাপ্লিকেশন লিখিয়ে নিয়ে নিজে সদরে ছুটে গিয়ে ডিএমকে দিয়ে অর্ডার করিয়ে মাকে জয়েন করিয়ে নিলেন ব্লক ওয়েলফেয়ার অফিসারের পদে। ঘটনাটা ঘটল, যেমন বললাম, একটানে, মাত্র তিনদিনের মধ্যে। মায়ের প্রথম পোস্টিং হল আমাদের দেশের বাড়ি থেকে আরও মাইল দশেক দূরে, ফুলিয়ায়। যা ডিউটির চাপ তাতে ডেইলি আসা যাওয়া একজন মহিলার পক্ষে অসম্ভব। সেজন্য মা থাকত ফুলিয়ার অফিস কোয়ার্টারে। আমার জন্মও সেখানকার হেলথ সেন্টারেই।

এদিকে বাবাদের দেশের বাড়ির জমিজমা নিয়ে তখন ব্যাপক গোলমাল। রিফিউজিদের সঙ্গে স্থানীয় মুসলমান প্রজাদের দারুণ রেষারেষি। নমশূদ্রদের বক্তব্য, তোমরা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছ। এইবার তোমরা চলে যাও পাকিস্তানে। এখানে কেন বসে আছ? 
মুসলমান প্রজারা থাকত আমাদের গ্রামের একমাত্র দালান বাড়িটার চারপাশ ঘিরে। ওখানে সলেমন ধাবকের মাজার। ফি বচ্ছর মেলা বসে। সেই মাজার ঘিরে মুসলমান পাড়ার পত্তন করে আমার ঠাকুরদার বাবা। ওরা চারপুরুষ ধরে নদীয়াবাসী। মূলত ঘরামি এবং মৎস্যজীবী। চাষে তত দক্ষ নয়। কিন্তু সামান্য জমি ভাগে করত। বছরের খোরাকিটা তো উঠে আসত। ওরা কিছুতেই পাকিস্তানে যাবে না।
দেখা গেল, রিফিউজিরা ভীষণ লড়াকু এবং কৃষিকাজে অসম্ভব দক্ষ। ওরা এসে পতিত জমিতেও ফসল ফলিয়ে ফেলল। বন জঙ্গল সাফ করে রিলিফের টাকায় পাওয়া ছেঁচার বেড়া আর টিনের চালা তুলে ঘোড়াঘাটা, খিসমা, এইসব জঙ্গলমহলের চেহারা পালটে দিচ্ছে।
বাবাকে এসে একদিন ভবেন্দ্র মৃধা বলে একজন নেতা টাইপের রিফিউজি চাষি ধরল, বাবাদের বসত বাড়ি থেকে দূরের জমিগুলো নমোদের নামে ভাগিদার হিসেবে চাষ করতে দিতে হবে। ওরা ফসলের ভাগ দেবে চারভাগের তিন ভাগ। স্থানীয় চাষির চেয়ে বেশি। কারণ, এরা অনেক বেশি পরিশ্রমী। ডোবার জল ডোঙা দিয়ে ছেঁচে তুলে জমিতে ধানের চারা লাগাচ্ছে। বেশি ভাগের লোভে বাবাদের বাকি ভাইরা সব জমি দিয়ে দিল নমশূদ্রদের। বাবা সবটা দিল না। কিছু দিল কিছু রাখল মুসলমান পাড়ার ভাগিদারদের হাতে। দেখা গেল, একদিন নমশূদ্র চাষিদের নেতা হয়ে ভবেন্দ্র মৃধা এসে বাবার নামের মুসলমান পাড়ার বাকি জমিগুলোয় ঢুকে ভাগচাষ করতে চাইছে।

সেই নিয়ে লেগে গেল লাঠালাঠি। ওকে তাড়া করে ঘরামিরা মারতে মারতে এনে ফেলল বাবাদের দোতলা দালানের বাইরের উঠোনে। মা অফিসে। বাবার পেছন পেছন হল্লা শুনে দাদুও লাঠিখানা নিয়ে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কী হয়েছে?
মুসলমান প্রজাদের দাবি, ভবেনকে নাকে খৎ দিয়ে এখুনি হলফ করে বলতে হবে ও এবং নমোরা কেউ মুসলমান পাড়ার এক ছটাক জমিতেও বর্গা করবে না। করুগগে বর্গা ওই দূরের খিসমা, ঘোড়াঘাটার জঙ্গলে।

বাবা থামতে বলল, কিন্তু বাবার কোনো কথা তখন মুসলমান ভাগিদাররা শুনতে রাজি নয়। ওরা লাঠি তুলল। ভবেন কাকা আর্তনাদ করে দোতলার দিকে মুখ করে বলে উঠল,
‘ন’বাবু। আমনি আমারে বাঁচান। এরা আমারে মারি ফেলাবে।’
চোখের সামনে একটা খুন হবে? তারপর থানা পুলিশ হবে? বাবাকে যদি ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষী দিতে ডাকে? এলাকায় বাবাদের পরিবারের একটা নাম আছে। বলবে, আপনারা থাকতে এটা হলো!

বাবা, হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে শ্বশুর মশাইয়ের হাত থেকে লাঠিটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল নিচে, ভবেনের হাতে। ভবেন সেটা নিয়ে লুফে নিয়েই এমন বেগে ঘোরাতে আরম্ভ করল যে, ঘরামিরা পেছু হটল। কিন্তু হাঁকাহাঁকি করে ওরাও দল বাড়তে লাগল ক্রমশ। বাবা দেখল বেগতিক। ভবেন সমানে পিছু হটছে। আর দেরি করা যায় না। ডবল ব্যারেলটা ঘর থেকে লোড করে এনে বারান্দা থেকেই শূন্যে চালিয়ে দিল এক রাউন্ড। ব্যাস। পলকে উঠোন ফাঁকা। ভবেনের বয়ানে একটা কাগজে সব লিখে টিপছাপ নিল ওর। বিষয়—দুষ্কৃতিদের হাত হইতে নিজের ভাগীদারের প্রাণ বাঁচাইবার জন্য শূন্যে এক রাউন্ড গুলে নিক্ষেপ। লাইসেন্স রিনিউয়ের সময় এসডিওকে টোটার হিসেব দিতে হবে তো। সঙ্গে এই বয়ানটা দিলে গুলি চালানোর কারণটা জোরদার হবে। 
এই অবধি কাহিনিটুকু বাবা এবং ভবেন কাকার মুখ থেকে টুকরো টুকরো ভাবে আমার শোনা।
তারপর থেকে প্রতি বছর ওই দিনটায় ভবেন কাকা এসে লাঠিটাকে ভালো করে তেল মাখিয়ে চান করাত চূর্ণী নদীর জলে আর বাবাকে প্রণাম করে বলত,
‘আপনি আর এই লাঠি আমার জেবন দাতা।’ 

আমরা শহরে চলে আসার পরেও ভবেন কাকা আমাদের বাড়ি এসে ভাগ দিয়ে গেছে নিয়মিত। টাকা জমিয়ে জমিয়ে বিঘে দশেক ভাগের জমি কিনে নিয়ে সে নিজেই একজন প্রতিষ্ঠিত রায়ত হয়ে গেল একদিন। তখন দেখা গেল ঘরামীদের সঙ্গে ভাবসাব হয়ে গেছে। তাঁদের কেউ কেউ আমাদের জমির সঙ্গে ভবেন কাকার জমিতেও বর্গা করছে। 
আজ বাবাও নেই, ভবেন কাকাও নেই। লাঠিটা সাক্ষীগোপাল হয়ে বাড়ির কোথাও এক কোণে পড়েছিল এতদিন। আজ আবার সামনে এলো।

দাদু দিদা দুজনই স্বর্গে যাওয়ার পর কাশীর বাড়ি রইল পড়ে ভাড়াটে বিধবাদের হাতে। ওঁরা কিন্তু সমানে মাসে মাসে মাথাপিছু একখানা করে ঘর বাবদ পাঁচ টাকা করে হিসেব করে দশ জন মিলে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া মানি অর্ডার করে পাঠাত আমাদের শহরের বাড়িতে। সহসা একটা চিঠিতে তেনাদের একজন কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন,
‘বাড়িতে গুণ্ডার উৎপাত দেখা দিয়াছে। উহারা বোমা মারিতেছে। জোর করিয়া মাঝে মাঝে একতলার দরজার খিল ভাঙিয়া ঢুকিয়া পড়িতেছে এবং মারধোরের হুমকি দিতেছে। আপনি শীঘ্র আসিয়া আমাদের রক্ষা করুন।’
চিঠি আসবার দুদিন পর দুজন অবাঙালি এসে আমাদের শহরের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। চেহারা দেখলে ভয় লাগে। কথাবার্তা শেষ করে তারা চলে যাওয়ার পর বাবা বলল, ওঁরা নাকি কাশীর গুণ্ডা। কথাবার্তা কিন্তু ভীষণ বিনয়ী। দুজনাই নিজেদের বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটির অধ্যাপক বলে পরিচয় দিল। কিন্তু ওই রকম টিপিকাল চেহারা নাকি বাবার দেখা কাশীর কুখ্যাত রামাপুরার গুণ্ডাদের ছাড়া হতেই পারে না।
বাবার উকিল সব শুনে বলল,

‘ওই বাড়ি আপনি রাখতে পারবেন না। যা দাম পান নিয়ে নিন। নইলে আম ছালা দুইই যাবে’। 
ওরা আবার এলো এবং গেল। দরদাম চলল বেশ কয়েকবার। শেষ অবধি চল্লিশ হাজারে ওই তিনতলা বাড়ির দাম রফা হল এবং বাবা কাশী গেল রেজিস্ট্রি করতে। শুধু বাড়ি নয়, খাটটাট সমেত দাদুদিদার যাবতীয় মালপত্র দিল বেচে। হিন্দু ইউনিভার্সিটির ওই দুই প্রফেসর, দেখতে গুণ্ডা, জলের দরে ভাড়াটে বাহিনী সমেত কিনে নিল অতবড় বাড়িটা।

শীতকাল এলে নতুন মা আমাদের টাউনের বাড়ির ছাদে বড়ি দিত। পাশেই লাঠিটা শুইয়ে রেখে নেমে আসত নিচে। শহুরে কালোমুখো হনুমানগুলো কোনদিন ঝামেলা পাকায়নি। শীতকাল চলে গেলে বাবা লেপগুলোকে গোল করে বাণ্ডিল বেঁধে, পেটের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে লাঠিখানা চালিয়ে দিয়ে দুই মাথায় বাঁধত মায়ের শাড়ির ছেঁড়া পাড়। তারপর কড়িবর্গার ফাঁকের সঙ্গে বেঁধে টাঙিয়ে দিত লেপের বাণ্ডিল। ব্যাস। সারা গরমকাল ওরা লাঠিটাকে পেটে ভরে নিয়ে ছাদের নিচে ঝুলত। 

আমার বিয়ে আর এক কন্যা হওয়ার বছর পাঁচেক পর নতুন মা যখন জানতে পারলো যে উনি আর বেশিদিন নেই, দুটো কিডনিই ড্যামেজ, তখন চোখ থেকে সমস্ত বাঁধ খুলে দিয়ে জল ঝরাতে ঝরাতে এতদিনে উন্মুক্ত করে দিল, বিয়ের পর বাবার মুখ থেকে শোনা, আমার প্রথম মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ের আগের প্রথম দেখা হওয়ার কাহিনি। 
ঠাকুরদা আর ঠাকুমার একসঙ্গে গুটি বসন্তে মৃত্যুর পর বাবা তখন শ্মশান বৈরাগ্যের শিকার। সংসারে মন নেই। ভাইয়েরা সম্পত্তি নিয়ে মামলায় মত্ত, বাবা চলে গেল কাশী। সেখানে গিয়ে কেদারঘাটের সিঁড়িতে রোজ বসে থাকতো আর রাত হলে চলে যেত কুমারস্বামী মঠের ধর্মশালায়। কেদারঘাট তখন দাদুর একচ্ছত্র বিচরণ ভূমি এবং ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে মিলনস্থল।

দাদুর চোখে বাবা কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়ে গেলেন। মুখ দেখেই বুঝলেন, বড় ঘরের ছেলে, কিন্তু মনে বিবাগী ভাব। পাশে বসে হাত রাখলেন পিঠে।
দাদুর বিশেষ ক্ষমতা ছিল মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার। দু’চার কথা মন ছুঁয়ে বলতেই বাবা দাদুর বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। দাদু তার হাত ধরে সোনারপুরার বাড়িতে এনে তুললেন। আলাপ করিয়ে দিলেন স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে। দেখা গেল, বাবার বিবাগী ভাব হাল্কা হয়ে আসছে। মা ম্যাট্রিক পাশ জমিদার তনয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। জমিদারদের ওপর মায়েরও শ্রদ্ধাভক্তি বিশেষ ছিল না। কিন্তু দাদু অনড়। তুই একমাত্র মাইয়া। আমরা আইজ আছি, কাইল নাই। আমি তোদের সবারে লয়া নদীয়া একবার যাইবার চাই। সব দেইখ্যাই তদের চার হাত এক করাব।
সবাই মিলে পাহাড়পুর ভিজিটের পরপরই দাদু পঞ্জিকা দেখে চারহাত এক করে দিল।

কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। আমি হওয়ার পর বাবা মাকে চাকরি ছাড়তে জোর করল। মা ছাড়ল না। এই নিয়ে বিবাদ নাকি শেষ দিন অবধি ছিল। কিন্তু লাঠি হাতে কৈলাশ চক্কোত্তি কাশী থেকে ছুটে আসবেন, এই ভয়ে বাবা আর বেশি দাপাদাপি করেনি। মা নাকি খুব মনোকষ্টে থাকতো এইসব নিয়ে। টাইমমতো খাওয়া দাওয়া করত না। শরীরের যত্ন নিত না। ফলে হার্টটাই গেল খারাপ হয়ে। আমার পরের ভাই আসার আগে ডেলিভারি টেবিল থেকেই মা চলে গেল।
আমি বললাম,
‘এতোদিন বলোনি কেন?’
‘যদি তুই তোর বাবাকে ভুল বুঝিস।’
আমি এইবার আর মায়ের কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা করলাম না। 
রঙের কাজ তিনদিনে শেষ হলো। সারা বাড়ি ধোয়া হয়েছে। আসবাবগুলো ফিরে এসেছে নিজেদের জায়গায়। কিন্তু লাঠিটা কোথায় গেল? মিস্তিরিরা নিয়ে গেল নাকি? উঁহু। ওদের সে বদনাম তো কোনদিন নেই।
লাঠি খুঁজতে নিচে নামলাম। দেখি, ওই তো, সিঁড়ির নিচে কাত হয়ে পড়ে আছে। সারা গায়ে হরেক রকমের রঙের ছোপ। কেউ পরিষ্কার করে দিয়ে যায়নি বেচারাকে। আজকাল রঙেরও অদ্ভুত সব নাম হয়েছে। সাদা রঙের কৌটোর গায়ে লেখা ‘অফ হোয়াইট’। কালোকে লিখেছে ‘ব্ল্যাক জাপান’, ইত্যাদি। লাঠিটার গায়েও লেগে রয়েছে সেই সব রং, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দরকার কী আমার অত খটোমটো সব নাম মনে রাখবার। লাঠিটা নিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রঙগুলোর নতুন নাম দিলাম ‘দাদু’, ‘বাবা’, ‘মা’, ‘ভবেন কাকা’ আর ‘নতুন মা’।
 


নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায় কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। ইতোমধ্যে দুইটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে :বারাঙ্গনা মহাযজ্ঞ এবং শ্লীলতাহানির উত্তরপর্ব। ভূমি বিষয়ক প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে তিনটি : বাংলার ভূমিব্যবস্থা, জরিপ ও রাজস্বের আইনগত বিবর্তন, ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলার ভূমিব্যবস্থার রূপান্তর ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। তিনি পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।

menu
menu