জীবনযাপন

 
—এত নিষ্ঠুর হয়ো না বাবা।
মার খেতে খেতে হারাণ বিড়বিড় করে বলল।
চোখের ভুরু কেটে রক্ত পড়ছে, দৃষ্টি ধূসর, মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে দুহাত একবার আকাশের দিকে মেলল।
বুড়ো হয়ে গেলে জীবন বড় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
সে কেন একখানা ঘর নিয়ে থাকবে? সে কেন খাবারে ভাগ বসাবে?
তাই রাস্তাতেই তার গতি।

এতটা না মারলেও চলত।
কিন্তু রাগ মাথায় উঠে গেলে দুলালের কোন হুঁশ থাকে না।
এমনকী তার বউ মালতী—যার উস্কানিতেই পথই ঘর হয়ে গেল হারাণের, সেও ভাবতে পারেনি দুলাল এতটা করে বসবে।
সে একবার দুলালের হাত ধরতে গেল, মার খেয়ে ফিরে এলো।
গোপাল, হারাণের নাতি, কাঁদছিল।
সে তো এসব আগে দেখেনি।
শুধু রোজকার রাগ চেঁচামেচিই শুনেছে বাবা মায়ের।

গোপাল প্রথমেই কেঁদে উঠেছিল যখন দুলালের দুই হাত হারাণের গলা চেপে ধরেছিল।
হারাণের প্রবল শ্বাসকষ্ট তখন, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
সে ভাবতেই পারেনি এরকম ঘটতে পারে।
মরেই সে যেত, যদি না তার আগে দুলাল লাঠি দিয়ে তাকে মেরে বাড়ির বাইরে বের করে দিত।
পথের ধারে পড়ে আছে হারাণ, তার প্রাণ তখনো ধুঁকছে।
যারা ভীড় করে দেখতে এসেছিল, তারা তখন মজা দেখতেই ব্যস্ত।
দিনমান অস্তাচলে যায়।
পিঁপড়েগুলো গায়ে উঠতে শুরু করেছে।
হারাণ মাঝে মাঝে নড়ছিল।
প্রবল তৃষ্ণা আর ক্ষুধায় তার শরীর থরথর করে কাঁদছিল।
অন্ধকারের দশদিক তাকে ক্রমশ ঘিরে ধরছিল, তার জমিন আসমান।

পরদিন সকালে হারাণকে বাড়ির সামনে দেখা গেল না।
কাজে বেরোবার মুখে দুলাল দেখল পথে হারাণ নেই, বউকে ডাকতে সে বলল সেও কিছু দেখেনি।
দুলাল ভাবল—যাক আপদ গেছে।
শুধু মনে পড়ল তার একবার প্রবল জ্বরের সময় তার মাথায় কে যেন হাত রেখেছিল, বলেছিল—খোকন, সেরে ওঠ সোনা।
কাজে গিয়ে দুলাল মন বসাতে পারল না, শুধু মনের আয়নায় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছিল রক্তমাখা এক করুণ মুখ।
পৃথিবীর কোন বিস্তৃত আকাশ তখন উদাস হয়ে যায়।

গরমের হলকায় মানুষেরা, গাছেরা, পশুরা ঝলসে যাচ্ছিল।
আকণ্ঠ তৃষিত পৃথিবী বড় তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকছিল।
তখন দূরের কোন দিগন্তে শরীর টেনে টেনে হেঁটে যাচ্ছে এক মলিন পথিক, তার সারাটা পথ কোন পাতাঝরা বিষণ্নতায় ভরে থাকছিল।
বাড়ি ফেরার পথে দুলাল দেখল মালতী উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে।
কাছে এসে মালতী রুদ্ধস্বরে বলল—ওগো গোপালকে দেখেছো?
—মানে?   
—সকাল থেকে তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথমে ভেবেছিলাম শ্যামলদের বাড়ি গেছে, সেখানে যায়নি, কোথায় গেছে জানি না।
দুলালের বুক ধ্ক করে উঠল।

মালতীর প্রথমের দিকে সন্তান হয়নি, অনেক পরের সন্তান গোপাল, মালতীর বড় প্রিয়।
মালতী দুলালকে ধরে ঝাকাচ্ছিল উন্মাদিনীর মতো।
—ছেলের সামনে বাবাকে মারলে কেন? আমি কি তোমাকে মারতে বলেছিলাম?
—তুই আমাকে উত্ত্যক্ত করিসনি দিনের পর দিন? বলিসনি ছেলেটার ভবিষ্যৎ কি হবে এই কটা পয়সায়?
মালতী থমকে গেল—হ্যাঁ সেও ত এই পাপের অংশীদার। 
মালতী দুলালের হাত ধরে করুণ সুরে বলছিল—ওগো, ছেলেকে আর  বাবাকে ফিরিয়ে আনো না গো, কথা দিচ্ছি যত কষ্টই হো‌ক, সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব।
দিগন্তের সেই বিষণ্ন পথিককে খুঁজতে গেছে এক বালক।
জীবনের ম্লানতা, দীনতা তখনো তাকে স্পর্শ করেনি।
তার এখনো মনুষ্যহৃদয়।
তার হাতে ধরা আছে তখনো না খাওয়া অন্ন।
দেখা হলেই যা সে পিতামহের মুখে তুলে দেবে।
দুলাল কাঁদছিল, মালতী কাঁদছিল, তারাও নেমেছে পথে—অনুসন্ধানে।
দূর মাঠ পেরিয়ে দিগন্তের বনভূমির দিকে চলে যাচ্ছে জীবন।
কয়েকটি ভাঙাচোরা মানুষ—তিন প্রজন্মের মানুষ আর এক নারী—সবার   গতিপথ হয়তো কোনো ভালোবাসার অনন্তরেখায় গিয়ে মিশছিল।
 


তপনজ্যোতি মিত্র কবি, গল্পকার ও প্রযুক্তিবিদ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে বসবাস করেন।

menu
menu