রূপকের কোনো স্মৃতি নেই

ছাদের বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে রূপক হঠাৎ বুঝতে পারল তার কোনো স্মৃতি নেই।
স্মৃতি থেকে বহুবার পালাতে চেয়েছে রূপক। আবার, বহুবার চেয়েছে এমন কোনো না কোনো স্মৃতি তার থাকুক, যেগুলো মনে করে তার ভালো লাগবে। কিন্তু আস্ত ৪৭ টা বছর পেরিয়ে এসে রূপক বুঝতে পারছে তার কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু এটা তো হতে পারে না। রূপক ঘাড় ঘুরিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। এই ছাদটা সেই পুরোনো ছাদটাই যে, এটা তো তার স্মৃতি থেকেই বলছে। তার মানে, স্মৃতি নেই তা তো বলা যায় না। কিন্তু রূপক এ ছাড়া তেমন আর কিছুই মনে করতে পারছে না। ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে সিঁড়ি দিয়ে রূপক।
কে একজন ছায়ার মতো বসে আছে সিঁড়ির ঠিক নিচে হলঘরটার সোফায়। টিভি দেখছে। মনে পড়ে গেল রূপকের। অপরাজিতা। রূপকের বউ। মহুয়ামাসির মেয়ে। মহুয়ামাসি কাজ করত তাদের বাড়ি। তার পর কীভাবে যেন বা একদিন অপরাজিতার সঙ্গে রূপকের বিয়ের ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের পর অপরাজিতার সঙ্গেও যে রূপকের তেমন কোনো স্মৃতি তৈরি হয়নি কেন, তা কখনো ভেবে দেখেনি রূপক।
মহুয়ামাসি বলেছিল, তুমি অপরাজিতাকে উদ্ধার করে দিলে বাবা।
কে কাকে উদ্ধার করে এই পৃথিবীতে কে জানে।
রূপক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতেই অপরাজিতা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, চা করে দেব?
ইশারায় হ্যাঁ বলে রূপক নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
রূপকের তো এখানে থাকার কথা নয়। কে যে কোথায় থাকতে শুরু করে এই পৃথিবীতে! কোন বাড়িটা যে তার নিজের হয়ে যায় আর কোনটা তার নিজের হওয়ার ছিল, আর হয় না, তার কোনো ঠিক থাকে না।
কোনো যোগসূত্র নেই আসলে কিছুর।
জল যেমন বয়ে যায়, তেমন ঘটনাও ঘটে যায়। বয়ে যাওয়া জলের সঙ্গে সঙ্গে জল নিজেও হয়তো ঠিক করতে পারে না সে কোথায় চলেছে।
ঘরের আলোটা জ্বালাতে ইচ্ছে করল না রূপকের।
আলো যখন আস্তে দিগন্ত থেকে মুছে যেতে থাকে, তখন যেমন সুন্দর, মোলায়েম এবং রঙিন হয়ে ওঠে অন্ধকারের মধ্যে আত্মসমর্পণের আগে, অনেকটা তেমন ভাবেই রূপক বসে পড়ল তার ঘরের মধ্যে। ঘরে কেউ নেই কারণ রূপকের ফ্ল্যাটে সে ছাড়া আর কেউই থাকে না। একটা লোক ধীরে ধীরে কীভাবে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, তা মনে হয় রূপককে ছাড়া বোঝা যাবে না। কিন্তু রূপক এমন বিচ্ছিন্ন ছিল না। রূপকের বাবাকে রূপক কোনোদিন চোখেই দেখেনি। শুনেছে, সে যখন খুব ছোটো, তখন তার বাবা মারা যায়। অনেকে বলে, রূপকের বাবা নাকি মারা যায়নি, চলে গেছে, নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কার কোন কথাটা সত্য, সে বিষয়ে খুঁটিয়ে দেখার অবসর পায়নি রূপক। কারণ তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার বাবার কোনো স্মৃতি তৈরি হয়নি। বাবাকে নিয়ে কৌতূহল থাকলেও, রূপক একটা বিষয় বুঝতে পারত, যার স্মৃতি নেই, তার শুরু বা শেষের সঙ্গে রূপকের কোনো সম্পর্ক নেই। রূপকের মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। এ ব্যাপারটাও তার নিজের চোখে দেখা নয়। কারণ জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে দেখেছিল সেই লোকটাকেই, যাকে সে বাবা হিসেবে চিনত। কিন্তু তার মা শিখিয়েছিল তার দ্বিতীয় বাবাকে পাপা বলে ডাকতে।
তার পাপা তাকে খুবই ভালোবাসলেও, তার মা যে তার পাপাকে নিয়ে ভালো ছিল না, তা বোঝা গেল যখন একদিন বাড়িতে কাজ করতে আসা মহুয়ামাসির চিৎকার শুনে বাগান থেকে দৌড়ে ঘরে ঢোকার সময় তাকে জাপটে ধরে মহুয়ামাসিই। আর তাকে নিয়ে দূরে সরে যায়। তারপর সে দেখেছিল তার মায়ের শরীরটাকে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে চলে গেল। তার বয়স তখন ছয়। ছ বছরের স্মৃতি সাধারণত মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু জীবনের কিছু কিছু বিশেষ ঘটনা মনের মধ্যে দাগ কেটে যায় এমন ভাবেই যে বয়স গড়িয়ে গেলেও সেই দাগ কখনোই ম্লান হয়ে যায় না। স্মৃতি অনেকটা পাহাড় কেটে কেটে নদীর পথ চলার মতো। একবার পাহাড় কেটে নদীখাত তৈরি হয়ে গেলে সেই গভীরতা থেকেই যায়। পাহাড়ের গায়ে ভাঁজের পর ভাঁজ দেখে মনে হয় কে যেন বা তুলির মতো সরু সরু আঁক কষে রেখেছে। স্মৃতিও এমন মনের মধ্যে এক একটা স্তরের মতো দাগ কেটে বসে যায়।
দাগ ব্যাপারটা এমনই। হয়তো ছোটোবেলা থেকেই এ কারণেই রূপকের মনের মধ্যে পুরোনো স্মৃতির মতো বাসা বেঁধে আছে এক বিচিত্র শূন্যতা। রূপকের মায়ের আত্মহত্যার পরে পাপার সঙ্গেই রূপক থাকত। পাপা লোকটা আস্তে আস্তে মিশে গিয়েছিল রূপকের মনের ভেতর। এলাকায় একটা বেশ বড় মুদির দোকান থেকে পাপা ক্রমশ একটা প্রোমোটার হয়ে যায় এবং একটা বড়ো আবাসন গড়ে তোলে। টাকাপয়সার অভাব ছিল না। পাপার নিজের মহিলাগত নানান সমস্যা থাকলেও তার সঙ্গে রূপকের প্রতি তার ভালোবাসার কোনো বিরোধ ছিল না। রূপক বড়ো হতে থাকে এভাবেই যাতে কোনো স্মৃতি তার মনের ভেতর জমে না যায়। পাপা নানান মহিলা নিয়ে আসত। কিন্তু কখনোই সে সব মহিলা তাদের বাড়িতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেনি। মহুয়ামাসি অবশ্য থাকত রূপকের সঙ্গে। আর থাকত বেশ কিছু লোক। কেউ মালী, কেউ বা রান্না করতে আসত। শোনা যায়, পাপার অন্য জায়গায় অন্য বাড়িও ছিল। পাপা মাঝেমাঝে বাড়ি আসত না। খুব একটা যে কথোপকথন হতো রূপকের সঙ্গে তার পাপার এমনও নয়। কিন্তু রূপককে একটা ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া থেকে টিউটরের ব্যবস্থা সবকিছুই করত পাপা। পাপার ছিল পানপরাগ খাওয়ার নেশা। মুখে পানপরাগ দিয়ে রূপকের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করত—কী বড়সাহেব সব ঠিক চলছে?
রূপক বলত, হ্যাঁ পাপা।
কিন্তু হ্যাঁ বা না বা এই চাই বা ওই চাই—এর পরে আর কোনো কথাই হত না তার পাপার সঙ্গে।
রূপক ভুলেই গেছিল তার আরেকটা বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা ছিল।
কিন্তু তার তো কোনো স্মৃতিই নেই মনে।
মহুয়ামাসি ছাড়া রূপকের পক্ষে এসব জানা সম্ভবই হতো না।
গত বছর মহুয়ামাসিও চলে গেল। মহুয়ামাসিকে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় যদিও রূপক যায়নি। যেমন যায়নি তার পাপা চলে যাওয়ার পরেও।
পাপার ব্যবসা ক্রমশ বাড়তে শুরু করার পর এলাকায় পাপার প্রতিপত্তিও বাড়তে শুরু করে। পাপা যে তলে তলে সমস্ত কিছু রূপকের নামেই নমিনি করে যাচ্ছেন, তা জানত না রূপক। সে শুধু জানত, তার নামেই সমস্ত লেখা আছে। পাপা মারা যায় যখন তখন রূপকের বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে। আচমকাই খবর আসে অফিসেই হার্ট অ্যাটাক। নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ। পাপাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু শেষযাত্রায় আর রূপক যায়নি। পাপার কাজ করেছিল মহুয়ামাসির ছেলে।
রূপক যেতে চায়নি। রূপক স্মৃতিকে ভয় পায়।
কিন্তু আজ হঠাৎই কোনো না কোনো স্মৃতির জন্য রূপকের মন ছটফট করছে।
কিন্তু স্মৃতি এমন একটা বিষয়, যাকে জোর করে তৈরি করা যায় না। অপরাজিতাকে বিয়ে করার পরে রূপক ভেবেছিল একটা স্মৃতি তৈরি হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছুই এমন প্রাত্যহিক হয়ে যেতে থাকল, যে স্মৃতি আর কিছুই তৈরি হলো না।
—আমি তোমার কাছে একটু স্মৃতি চাইতে পারি?
—কী বলছ? কী সব বলছ আমার ভয় করছে।
রূপক অপরাজিতার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল একটা অসহায়তা গ্রাস করছে তাকে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়লেও মানুষ হিসেবে অসম্ভব ভালো এই অপরাজিতা। লোকে ওকে অপা বলে কেন ডাকে, সেটিই এখনো বুঝতে পারেনি রূপক। কিন্তু অপরাজিতার মুখের আদলে তাদের স্কুলের সেই অনন্যার মুখের একটা আদল আছে। অনন্যা কি একটা স্মৃতি রূপকের কাছে? কিন্তু অনন্যার মুখটাও ঠিক মনে পড়ে না রূপকের।
—না, অপরাজিতা, আমি আসলে চাইছি আমাদের মধ্যে এমন কিছু ঘটুক, যা আমি কখনো ভুলতে পারব না।
—বর বউ-এর মধ্যে যা হয়...?
অপরাজিতা সুখেই আছে। কিন্তু অপরাজিতারও মনের সাধ পূরণ হয়নি। তাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। ডাক্তার দেখিয়ে বুঝেছিল রূপক সমস্যাটা তারই। স্পার্মকাউন্ট কম।
অর্থাৎ, সে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না।
অপরাজিতাকে সে বারবার বলেছিল তাকে ডিভোর্স করে অন্যকাউকে বিয়ে করতে। কিন্তু অপরাজিতা তা করতে চায়নি।
মনে মনে কি অপরাজিতা ভালোবাসে রূপককে?
রূপক বিশ্বাস করতে পারে না। রূপকের মনে হয় অপরাজিতা সুখে আছে। তার জীবনে কোনো সঙ্কট নেই। তার স্বপ্ন দেখার দায় নেই। স্বপ্নকে স্বপ্ন দেখারও দায় নেই। তার জীবনে হয়তো এমন সব স্মৃতি রয়েছে, যে সব স্মৃতিগুলোকেই সে ফিরে ফিরে দেখে। নিজেই নিজের স্মৃতি ফিরে ফিরে দেখার মধ্যে একটা জীবন আছে। মানুষ কি নিজেই নিজের জীবনে বারবার বাঁচে?
রূপক মনে মনে অপরাজিতার থেকে দূরে সরে গেলেও বুঝতে পারে, অপরাজিতার সঙ্গে তার থাকা এখন বাড়ির আসবাবপত্রের সঙ্গে থাকার মতোই হয়ে গেছে।
অপরাজিতার মনের মধ্যে রূপক সম্পর্কে তেমন কোনো ভাবনাও নেই।
সে সারাদিন ঘরের কাজ, বাগান ইত্যাদি নিয়েই কাটায়। কখনো কখনো বাগান করে। কখনো কখনো নিজের বাড়ি চলে যায়। নিজেদের গ্রামে চলে যায়।
পাপার ব্যবসা রূপকের পক্ষে চালানো সম্ভব হয়নি। লোকে ভাবে, এত বড় ব্যবসা হাতের মুঠোয় পেয়েও তার ছেলে ব্যবসা চালাতে পারল না। কিন্তু আসল কথা হলো, রূপক নিজেও চালাতে পারেনি। এমনকি সে চালাতে পারবে না জেনেই পাপা বহু আগেই তার পার্টনারকে ব্যবসার অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। মালিকানাও বেচে দিয়েছে। তারপর টাকাটা রূপকের নামে করে দিয়েছে।
রূপকের প্রচুর টাকা। বাড়ি। বাগান। খাওয়ার লোকের অভাব। এমনকি রূপকের ছেলেমেয়েও হবে না, এ বিষয়েও নিশ্চিত।
—আমরা যদি একটা ছেলে বা মেয়েকে দত্তক নিই?
প্রস্তাবটা দিয়েছিল অপরাজিতাই প্রথম।
রূপককে কেউ দত্তক নেয়নি। কিন্তু রূপকের পাপা রূপককেই সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছে।
এ ভারি অদ্ভুত বিষয়। রূপক মাঝেমাঝে ভাবে। ভাবে, আর তার মনে হয় সে যে জীবনটা যাপন করছে, এ জীবনটাই তার নয়। অন্য কোনো জীবন হওয়া উচিত ছিল তার। কিন্তু সে যাপন করছে অন্যের জীবন। তার জীবন হলে কেমন হতো? কিন্তু সে জীবনের কোনো স্মৃতি তার নেই।
—তুমি সায় না দিলে আর আমি কীভাবে আনব? তুমি হ্যাঁও বলো না, নাও বলো না।
অন্ধকার হয়ে এসেছিল রূপকের ঘর। কখন যে চা নিয়ে ঘরে এসেছে অপরাজিতা, রূপক বুঝতেও পারেনি। রূপক এভাবে অন্ধকার ঘরের মধ্যে বসে থাকে। অন্ধকারের মধ্যে থাকার একটা সুবিধা হলো, আর অন্য কিছু দেখতে হয় না। অন্ধকারের মধ্যেই মিশে থাকে সমস্ত কিছু। মানুষ কি এইজন্যই অন্ধকার ঘরই বেছে নেয় ঘুমোনোর জন্য?
অন্ধকার ঘরে মানুষ কি নিজের স্মৃতির কাছে ফিরে যায় বেশি?
—তোমাকে কিছু বললে আজকাল আর জবাব দাও না কেন?
অপরাজিতার কথায় আবার হুঁশ ফিরল রূপকের। রূপক অন্ধকারের মধ্যেই তার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বাচ্চা। তার দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে?
—মানে? আমাদের আর কে আছে? তোমার বাবা তো অঢেল টাকা দিয়ে রেখেছে তোমাকে। তোমার পর সেই সব কে খাবে? না হয় একজন অনাথকেই দত্তক নিলাম আমরা।
—কিন্তু সে অনাথ কী করে জানলে?
—অনাথ নয়? হয় অনাথ না হয় তার বাবা মা তাকে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। এ নিয়ে আবার ভাবার কী আছে? কোনো কোনো লোকের ইচ্ছে থাকলেও বাচ্চা হয় না, আবার কেউ কেউ বাচ্চার জন্ম দেয়। তাকে রাস্তায় ফেলেও দেয়।
—কিন্তু নিতে গেলে একদম বাচ্চাকে নিতে হবে।
—কেন?
—একটু বড় হয়ে গেলেই তার নিজের স্মৃতি তৈরি হয়ে যায়। তার মনে থাকে সব।
—তোমার কী মনে আছে শুনি? শুনেছি তো তোমার নিজের বাবা মারা গেছে না হারিয়ে গেছে তাও কেউ জানে না। তোমার মাও আত্মহত্যা করেছে। তোমার কী মনে আছে? পাপা তো তোমার নিজের বাবাও নয়। তুমিও তো আসলে অনাথ।
—আমি জানি
—তুমি কী জানো?
—তুমি বুঝবে না। আমি জানি এসব আমার নয়। আমার কিছু মনে নেই। আমার কিছু মনে থাকার কথাও নয়।
—তোমার কিছু মনে নেই যখন তখন ভুলে যাও না। একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলে তো নতুন করে তোমার মনে সে থেকে যাবে। তাকেই ভাববে।
—কিন্তু সেও যদি স্মৃতি হয়ে যায়? আমি চাই না কেউ স্মৃতি হয়ে যাক। আমি চাই সে জীবনে বাস্তব থাকুক।
—তুমি বাচ্চা নেবে না নেবে না?
—তুমি চেয়েছ আর আমি না বলেছি এমনটা কখনো হয়েছে?
অপরাজিতা অন্ধকার ঘর থেকে আবার বেরিয়ে গেল। মনে হয় মনে মনে একটু খুশিই হয়েছে। ফাঁকা জীবনে একটা বাচ্চাকে হয়তো সে চাইছিল। ঠিক এসময়েই বাইরের গলির লাল ভেপারের আলোটা জ্বলে উঠল। এ আলো এখানে অনেকদিনের। আলো বাইরে থেকেই আসে। ভেপারের আলোও বাইরে থেকে আসে। আসলে যে লম্বা জিরাফের মতো গলা করে ল্যাম্পপোস্টটা অন্ধকার আকাশ থেকে গলির ওপর আলো দেয়। আর সেই আলো ঠিকরে নেমে আসে রূপকের ঘরের ভেতর।
এই সময় রূপকের ঘরের ভেতরের অন্ধকার এবং ভেপারের আলো মিলেমিশে এক অদ্ভুত আলোর জন্ম হয়।
এই আলোটিকে রূপক ঠিক কোনোকালেই বুঝে উঠতে পারেনি। এই আলোই কি বিস্মৃতির আলো? না কি ঘরের মধ্যে যে নিয়নের সাদা ফ্যাটফ্যাটে শীতের মতো আলো জ্বলে থাকে, সে আলোই বিস্মৃতির। মানুষ বেঁচে আছে মানে কি তার স্মৃতি বেঁচে আছে? স্মৃতিই কি তবে জীবন? ধীরে ধীরে স্মৃতি হারিয়ে ফেলাই তবে মৃত্যু? আর যার কোনো স্মৃতি তৈরিই হলো না কখনো, সে কি তবে মৃত? বেঁচে থেকেও মৃত?
কলিংবেলের শব্দে রূপকের চমক ভাঙে।এই ভরসন্ধেবেলায় আবার কে এলো।
কিছুক্ষণ পরেই উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজে রূপক টের পেল অপরাজিতা কার সঙ্গে কথা বলছে।
রূপক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে হলের দিকে যায়।
সোফায় একজন লোক বসে আছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না।
অপরাজিতা এগিয়ে এলো।
কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে রূপকের। কে আসতে পারে?
অপরাজিতা বলে উঠল, এই যে উনি এসে গেছেন। তোমার ওকে মনে আছে?
সামনে একজন তারই বয়সী, বা তার চেয়ে একটু বেশি বা একটু কম। উঠে দাঁড়ালেন সোফা থেকে।
রূপক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন—আমাকে দেখে তুমি চিনতে পারবে না।
অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে রূপক আবার সেই লোকটির দিকে তাকাল।
—আমি চিনতে পারছি না। কিন্তু আপনি?
—তুমি। আমাকে তুমি বলবে।
—সে তো হলো। কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি না।
—আমি তো তোমাকে চিনি। একটু দেখা করতে এলাম। ভালো আছ তো?
—হ্যাঁ কিন্তু তুমি কে?
—ওই তো বললাম আমাকে তুমি চিনবে না।
সঙ্গে সঙ্গে সরলমতি অপরাজিতা বলে উঠল—হ্যাঁ, উনি বললেন, রূপক আমাকে দেখে চিনতে পারবে না। তাই নামটা আর বলছি না। একবার দেখা করতে এসেছি।
—আপনার নাম?
—আমার নাম বললেও তুমি চিনতে পারবে না।
—তাহলে আমাকে তুমি চিনলে কী করে?
—আমি তোমাকে চিনি। বহুদিন ধরে চিনি।
অপরাজিতা বলে উঠল—উফফ, নিশ্চয় মজা করছ দুজনে। আমি চা করে আনি।
অপরাজিতা ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরে রূপক লোকটিকে বলল—দেখুন, সত্যি করে বলুন আপনি কে? কারণ আমার কোনো স্মৃতি নেই। অন্তত আপনার নামটা বলুন।
—আমার নাম রূপক।
—রূপক?
—হ্যাঁ। অন্যরকম হয়ে গেছি। আসলে মানুষের স্মৃতির ওপর নির্ভর করে তাকে কেমন দেখতে হবে।
—এমন আবার হয় নাকি?
—হয় না ? যার জীবনে দারুণ সব স্মৃতি, তার চোখ মুখ অন্যরকমের হয়। আর যার জীবনে শুধুই যন্ত্রণার স্মৃতি, তার চোখ মুখ অন্যরকমের হয়ে যায়।
—স্মৃতির ওপর মানুষের চেহারা নির্ভর করে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি অন্যরকম। তুমি অন্যরকম। কিন্তু কদিন ধরে আমার মনে হচ্ছে আমার স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই একটু শেয়ার করতে এলাম। যাতে আমার স্মৃতিগুলো হারিয়ে না যায়। আর তোমার স্মৃতিও শুনব। তাতে আমার টাটকা নতুন সব স্মৃতি তৈরি হবে।
—তুমি আমার কাছ থেকে কী শুনবে? আমার সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। আমার কোনো স্মৃতি নেই।
—আমার স্মৃতি অল্প আছে। তাই বলতে চাইছি, যাতে আমরা দুজনেই বাঁচি।
—কিন্তু তুমি কে?
—আমি রূপক। মানে তুমিই। তোমার মা যদি তোমার পাপার সঙ্গে এখান চলে না আসত, তাহলে তোমারও জীবন যা হতো, আমি তা-ই।
—কিন্তু তা কী করে হবে? এ তো উল্টোপাল্টা ব্যাপার। একজীবনে দুই জীবন বাঁচা যায় নাকি?
—যায় না? একজীবনে অসংখ্য জীবন হয়। একটা বিন্দু থেকে শুরু হয়। একটা কোনো ঘটনা থেকে যখন দুটো সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন দুটো জীবনই শুরু হয়ে যায়। আমার কাছে সেই জীবনের স্মৃতি আছে। তোমাকে বলব আমি ভুলে যাওয়ার আগে।
অপরাজিতা চা এনে দিয়ে বলল, তাহলে আমি ভেতরে যাই, তোমাদের কথা হোক। আমার সামনে তো বলবে না। তাই মজা করছিলে।
রূপক অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা একটু হাঁটতে যাই চা খেয়ে?
অপরাজিতা বলল, হ্যাঁ। আমারও কাজ আছে।
রূপক এবং রূপক চা শেষ করে বাগানে চলে গেল। দুজনের মধ্যে কিছু কথা হলো। তার পর অতিথি রূপক গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল দূরে।
অপরাজিতা বারান্দা থেকে রূপককে ডেকে বলল, হিম পড়ছে, ভেতরে এসো।
রূপক একটা আধোঘোরের মধ্যে ভেতরে এসে অপরাজিতাকে বলল, ভাগ্যিস লোকটা এলো।
অপরাজিতা সমান আনন্দের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। আমি তো ফোন করেছিলাম অদিতিকে। বাচ্চা হয়নি যাদের, তাদের বাচ্চা দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে যে হেল্প করে। ওর কাছ থেকেই নম্বর আর ঠিকানা পেয়ে এসেছে। তোমার সঙ্গে কথা হলো?
—মানে, আমার সঙ্গে তো এ নিয়ে কথা হয়নি। কী ব্যাপারে?
—সে কী! কিছুই হলো না? ওই লোকটার কাছ থেকে একটা বাচ্চা আমরা নিয়ে আসব। লোকটা একটা অনাথ শিশু কুড়িয়ে পেয়েছে। একটা কোন হোমে কাজ করে।
—কিন্তু তাহলে অন্য কেউ আসবে। এ তো অন্য।
—না, আমাকে বলল, যেতে। আমি তো কাল যাব লোকটার অফিসে। বলল, একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। ছোট্ট বাচ্চাটার বাবা নিরুদ্দেশ। আর তার মা এই বাচ্চাটাকে আর টানতে না পেরে হোমে দিয়ে এসেছে। লোকটার নাম কী গো? কিছুই বলেনি।
রূপক ধরা গলায় বলল, লোকটার নামও রূপক। হয়তো বলতে ভুলে গেছে।
হিন্দোল ভট্টাচার্য কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। নয়ের দশক থেকেই কবিতা লিখছেন। ১৯টি কাব্যগ্রন্থ, দুটি উপন্যস, দুটি ছোটোগল্প এবং তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রয়েছে। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি পুরস্কার’, ‘বীরেন্দ্র পুরস্কার’, ‘বিনয় মজুমদার সম্মান’, ‘ভাস্কর চক্রবর্তী স্মৃতি’ পুরস্কার। ছোটগল্পে নতুন আঙ্গিক এবং ভাবনা আনার প্রচেষ্টা করছেন। এছাড়াও মূল জার্মান ভাষা থেকে জার্মান কবিতা ও গল্পের অনুবাদ করছেন প্রায় ১৭ বছর ধরে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।