করবী


করবী
আদনান সৈয়দ

করোনার লকডাউনের কারণে গোটা দেশ এখন অচল। অচল হয়ে আছে ঘটক সাথী ভাইয়ের ছোট অফিসটাও। অথচ এই মাস দুয়েক আগেও সাথী ভাইয়ের ছিল রমরমা ব্যবসা! এখন শহরের চারদিকে সুনসান নীরবতা! নীল রঙের অফিসের দরজায় এখন বড় একটা লোহার তালা ঝুলছে। লকডাউনের এই খরার দিনে ঘরে বসেই দুই একজন খদ্দের পাওয়াও এখন ভাগ্যের ব্যাপার!  ভদ্রলোকের পুরো নাম সাইফুর রহমান সাথী। তবে তিনি ঘটক সাথী ভাই নামেই পরিচিত। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। চুল কাশফুলের মতো ধবধবে সাদা। স্বাস্থ্য ভালো। গৌড় বর্ণের এই ছোট-খাট মানুষটাকে দেখলেই কোথায় যেন একটা শ্রদ্ধাবোধ চলে আসে। দেখলে মনে হয় যেন প্রাচীন কোন এক দেবদারু গাছ! একটা বৃক্ষের মতোই মানুষকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন! ঘটক সাথী ভাইয়ের নাম শুনেই বুঝতে পারছেন বিয়ের পাত্রপাত্রীর নিয়ে তার কারবার। হার্টের অসুখে স্ত্রী মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেদুটো বিয়ে করে নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমানে মেয়ে করবীকে নিয়েই তার প্রতিদিনের জীবন। আগেই বলেছি এই কদিন আগেও সাথী ভাইয়ের ব্যবসা ছিল রমরমা। এখন করোনার এই মন্দাকালে মেয়ে করবীকে নিয়ে এক ভাড়া বাসায় লকডাউন হয়ে আছেন। ব্যবসা পাতি না থাকায় সময়টাও খুব খারাপ।  আর সে কারণেই সারাদিন তিনি মোবাইলটার দিকে বকের মতো তাকিয়ে থাকেন। যদি কোনো কল আসে?  আর যাই হোক করোনা ভাইরাসতো মানুষের বিয়ে-শাদি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!  এসব ভাবতেই ভাবতেই হঠাৎ করে  এক সুনসান বিকেলে সাথী ভাইয়ের মোবাইলটা এক অপরিচিত নাম্বারে ঝনঝনিয়ে বেজে উঠে। 
“স্লামালেকুম।” 
“ওয়ালাইকুম সালাম।”
ঘটক সাথী ভাই বলছেন?
“জ্বী বলছি” বলতে বলতে সাথী ভাইয়ের চোখ আনন্দে নেচে উঠল। তার প্রাণে যেন একটা আশার আলো জ্বলে উঠল।
“ভাই, ভালো করেই জানি এই দুঃসময় বেশিদিন আর থাকবে না। খারাপ সময় চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটাকেও বিয়ে করাতে চাই। একটা ভালো পাত্রীর খোঁজ দিন।”
সাথী ভাই এই বিষয়গুলো বেশ ভালোভাবেই হ্যান্ডেল করতে পারেন।  তিনি জানেন পাত্রের মা ঠিক কী ধরনের পাত্রী খুঁজছেন। রং ফর্সা, লম্বা, স্লিম, শিক্ষিত এসব আবদার তাদের থাকবেই। তারপরও তিনি হাসতে হাসতে জানতে চাইলেন
“কেমন মেয়ে খুঁজছেন আপনার ছেলের জন্যে? কেমন পুত্রবধু চাই আপনার?”
“এই ধরুন, দেখতে শুনতে ভালো। গায়ের রং ফর্সা, স্লিম, ভালো বংশ, শিক্ষিত আর আধুনিক। বুঝতেই পারছেন এই যুগে ভালো মেয়ে পাওয়া কঠিন। আপনার উপর ভরসা করছি ভাই।”
সাথী ভাই পেশাদার ঘটক। তিনি ভদ্রমহিলাকে আশ্বস্ত করলেন। এবং তার ছেলের বায়োডাটা এবং ছবি সাথীভাইডটকম এ মেইল করে পাঠাতে বলে ফোন ছাড়লেন। 
ফোনটা ছেড়েই মুখটা বিকৃত করে নিজেই বিড়বিড় করে ভদ্রমহিলার কথাগুলো রিপিট করলেন, “স্লিম, ভালো বংশ, অবশ্যই ফর্সা... যত্তসব!” তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন এ পর্যন্ত তার সব খদ্দেরই তাদের সম্ভাব্য পুত্রবধুকে ফর্সা, স্লিম, সদবংশীয় দেখতে চান। অথচ তারা কখনো মেয়েটির রুচিবোধ, সততা, ব্যক্তিত্ব এসব নিয়ে মাথা ঘামান না! মেয়ে যেন অর্ডার দিয়ে কেনা একটা ভেজিটেবল পিজা! টপিং এ অলিভ হবে কী হবে না, ওনিয়ন  কী পরিমাণে থাকবে, রেড চিলি কতটুকু দিতে হবে, চিজ ডবল নাকি সিঙ্গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঘটক সাথী ভাই এসব ভাবনা  নিয়ে খুব গভীরে যেতে চান না। কেন যাবেন? তার কাজ হল অর্ডার অনুযায়ী ‘জিনিস’ সাপ্লাই দেওয়া। এসব নিয়ে বেশি ভাবলে ব্যবসা চাঙ্গে উঠবে! এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি লিভিং রুম থেকে হেটে  ড্রয়িং রুমে মন খারাপ করে এসে বসলেন। 
ড্রয়িং রুমে বাবাকে বিষণ্ন মনে বসে থাকতে দেখে আহ্লাদী মেয়ে করবী বাবার গা ঘেষে এসে বসল।
 “বাবা! আজ আবার মন খারাপ কেন? পাত্র পক্ষ সুন্দরী পাত্রী খুজছে বুঝি?” মেয়েটা যেন তার বাবার পেটের সব কথা শুনতে পায়। সাথী ভাই চেয়ারে হেলান দিয়ে মেঝের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বেশ বোঝা যায় তার মনটা আজ কোনো কারণে ভালো নেই। মেয়েটা বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আবার বললো
“বাবা, তুমি আমাকে নিয়ে খুব ভাবো—তাই না?”  
সাথী ভাই এবার মাথা নেড়ে নেড়ে  উত্তর দিলেন, “আরে দূর বোকা মেয়ে। তোকে নিয়ে আমি কী কেন ভাববো? তোর মতো এত ভালো মেয়ে এই পৃথিবীতে আছে?  শুধু আমার মেয়ে বলে বলছি না তোর মতো সুন্দর...”
করবী এবার বাপকে মাঝ পথেই থামিয়ে দেয়।
 “থাক থাক। হয়েছে হয়েছে। এবার একটু বিশ্রাম নাও। এই দ্যাখো আমি তোমার প্রিয় বেলের সরবত নিয়ে এসেছি।”
 ঘটক সাথী ভাই বেলের সরবত খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন।
করবীর সঙ্গে আপনাদের একটু পরিচয় করিয়ে দেই। বয়স আটাশ। গায়ের রং কালো। চোখদুটো বড় বড়, মায়া মায়া। উচ্চতা পাঁচ ফুট। ছেলেবেলায় চিকেন পক্স হওয়ার কারণে মুখে সেই দাগ এখনো স্পষ্ট। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, মার্জিত এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী বলতে যা বোঝায় তিনি ঠিক তাই। পেশায় একটি স্কুলের শিক্ষক। এখনো অবিবাহিত। বাঙালি সমাজে পাত্রীর সংজ্ঞায় তিনি মোটেও সুন্দরী নন। খুব প্রাণ চঞ্চল এই মেয়েটি সারাক্ষণ গুনগুন করে, সিনেমা দেখে আর বই পড়ে নিজেরমতো করে সময় কাটায়। কিন্তু এখন বিয়ের বাজারে পাত্রীর গায়ের রং খুব গুরুত্বপূণ। সবাই সুন্দরী মেয়ে খোজে। তাদের দৃষ্টিতে পাত্রী মানেই সাদা ফকফকা সুন্দরী। এদের মধ্যে যারা চিকনা চালাক টাইপের তাদের মন্তব্য হলো— “আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী।” সাথী ভাই ভাবেন এসব মানসিকতা এখনো আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে কত ভালোভাবেই না টিকে আছে! তবে এই নিয়ে করবীর মনে কোনো দুঃখ নেই। কারণ সমাজ সংসার, বিয়ে এসব নিয়ে তিনি ভাবেন না। বরং ভাবনাটা তার  বাবাকে নিয়ে। সারাক্ষণ মেয়ের চিন্তায়  তিনি ব্যস্ত! ঘটকালি করে এত মানুষের তিনি বিয়ে দেন অথচ নিজের মেয়ের জন্যে কিছু করতে পারছেন না। 
সাথী ভাই প্রায় প্রতিদিনই তার ওয়েবসাইটের ডাটাবেইজ থেকে সংগ্রহে রাখা সম্ভাব্য সুন্দরী পাত্রীদের ছবি পাত্রের মার ইমেল ঠিকানায় পাঠাতে শুরু করেন। তার ধারণা খদ্দের খারাপ না। একবার বাগে আনতে পারলে করোনাকাল নিয়ে আর ভাবতে হবে না। সেদিন হঠাৎ করেই সন্ধ্যায় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা কল এল।  হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে এক যুবকের কণ্ঠ। জানা গেল যুবকটির নাম আশিক। ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তিনিই সেই কথিত পাত্র! যাক লক্ষণ ভালো। পাত্র নিজেই কিনা কল দিয়েছে! আনন্দে নেচে উঠলেন ঘটক সাথী ভাই। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে একটা ভদ্রতাবোধের ঘ্রাণও তিনি খুঁজে পেলেন। আশিক একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বড় চাকুরে।
সাথী ভাই এবার আশিককে সোজা প্রশ্ন করলেন, ” আপনাকে যে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম সেখান থেকে কোনো একটি কী আপনার পছন্দ হয়েছে? দেখুন, আপনার মা আপনার হবু স্ত্রীর বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আমি সেসব দিক বিবেচনা করেই কিন্তু আপনাকে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম। আর আপনি চাইলে আমাদের ওয়েবসাইট থেকেও যেকোনো ছবি পছন্দ করে আমাকে জানাতে পারেন।”
“ঠিক বলেছেন। সে কারণেই আমি আপনাকে কল দিয়েছি। আপনাদের ওয়েব সাইট দেখে একটি মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। অবশ্য জানি না তিনি আমাকে পছন্দ করবেন কিনা। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কী কথা বলতে পারি?
“অবশ্যই। অবশ্যই।” এটাই তো আমার কাজ। সাথী ভাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন! বলুন দেখি কত নাম্বর মেয়েটার কথা বলছেন? এই বলে সাথী ভাই দ্রুত তার লেপটপটা খুলে বসলেন। আশিক এবার কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা নাম্বার দিল। ২২৯৯৫৪।
সাথী ভাই নাম্বারটি বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতে করতে কম্পিউটারের ডাটাবেইজে নাম্বারটা দিলেন। নাম্বার এর ফলাফল দেখে তিনি এবার খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
“আপনার নাম্বারটা ঠিক আছে তো? ২২৯৯৫৪? নাকি কোন ডিজিট ভুল করছেন?”
আশিক আবার খুব সহজ ভাবেই বললো, “না না এটাই ঠিক নাম্বার। আমি শতভাগ নিশ্চিত।”
এবার সাথী ভাই চুপ হয়ে গেলেন। শুধু আস্তে আস্তে বললেন, “কিন্তু আপনি এই মেয়েকে কেন বাছাই করলেন? তার বায়োডাটা ঠিকমত পড়েছেন? সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে মেয়েটার গায়ের রং কালো, মুখে বসন্তের দাগ। শিক্ষিত। বয়স ২৮।  অথচ আপনারা চাচ্ছেন সুন্দরী, স্লিম, রং ফর্সা ...। ” কথা বলতে বলতে সাথী ভাই রেগে গেলেন। রেগে গেলে তিনি কাঁপতে শুরু করেন। 
ওপাশ থেকে আবার আশিকের কণ্ঠ। “কিছু মনে করবেন না। আমার মা আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর খোজে আপনাকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সে জন্যে আমি নিজেও লজ্জিত। বিশ্বাস করেন আমি মোটেও সে ধরনের কোনো পাত্রী সন্ধান করছি না। আমি চাই আমার জীবন সঙ্গী হবে এমন কেউ যিনি হবেন একজন আমারমতোই সাধারণ মানুষ যার সঙ্গে কথা বলা যায়, ঝগড়া করা যায়, ভালোবাসা যায়।  আপনার ওয়েবসাইটে এই মেয়েটা নিজের সম্পর্কে যে  তথ্যেটা দিয়েছে সেটি একবার পড়ে দেখেছেন? তিনি লিখেছেন, “আমার নাম করবী। আমি কালো, বেটে, মুখে বসন্তের দাগ, শিক্ষিত...।”  “ভাবতে পারেন একজন মানুষ কতটুকু সৎ আর ব্যক্তিত্বশীল হলে এই যুগে এভাবে সত্যকে নিয়ে বাঁচতে পারে?  দয়া করে মেয়েটির সঙ্গে একটু  পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন?  প্লিজ!”
ঘটক সাথী ভাই যুবকটার সঙ্গে সব কথা শেষ করে ড্রয়িং রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন।  তারপর জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের আকাশটা অনেক্ষণ ধরে দেখলেন। আহা! আজ আকাশটা কী ভয়ানক নীল! কত সুন্দর! এদিকে বারান্দায় টবে লাগানো বেলি ফুলের ঘ্রাণেও চারদিক বাতাসটা মৌ মৌ করে উঠেছে। পৃথিবীর এত সুন্দর! ঘটক সাথী ভাই অনেকদিন দেখেননি!

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu