এক ‘আহা পিঁপড়ে’-র জীবনপঞ্জি

ডায়েরি লিখিনি আমি কখনো। নোট নেইনি কোনোদিন। প্রয়োজনে আঁকড়ে ধরি স্মৃতির খড়কুটো। ওই স্মৃতি-বিস্মৃতি, যারা পিঠোপিঠি ভাই, তাই নিয়ে আমার এই পেছনে ফিরে তাকানো। যেটুকু দেখতে পাই, যা যা ঝাপসা হয়ে যায়—এসব মিলেমিশে আমার কাছে অনেক কিছুই কিন্তু দৃশ্য হয়ে আসে। মনে পড়ে, আবার মনে পড়েও না। এরকম এক অবস্থায় পৌঁছে অতীব ক্ষীণকায়, এক অকিঞ্চিৎকর লিটল ম্যাগাজিনের জীবনপঞ্জি, তবে বেঁচে-বর্তে থাকা, যুদ্ধ এবং মরে যাওয়া বা আবার ইতিহাসের সেই ফিনিক্স পাখির মতো অবশেষে বেঁচে ওঠার কাহিনি লিখতে গিয়ে প্রথমেই আজ মনে পড়ে গেল ‘ইদুর’, অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতা :

আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা—
স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলা— 
আলোয় গন্ধ ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভরে রাখুক
আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক।

যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একটি লিটল ম্যাগাজিন কীভাবে করুণা-নির্ভর হয়ে বাণিজ্য-সফল পত্র-পত্রিকার মাঝে তবু মরতে মরতে বেঁচে থাকে। সদা চলমান থাকে, চলে তার কথা বলাও। ধুলোর রেণু মেখে সে, ছোটো পিঁপড়ে, আবহেলায় থেকেও আকর্ষণ করে অনেক দৃষ্টি। সে যে ‘আহা পিঁপড়ে’, সে ঘুরুক দেখুক থাকুক না! যেমন করে অপাঙক্তেয় অনেক কিছুই পড়ে থাকে আমাদের চারপাশে।

ফেলে আসা যৌবনের পরিত্যক্ত শহরের কথা মরে পড়ে। হ্যাঁ, বর্ধমানের কথা চোখে ভাসে, ওই শহরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বড়ো হওয়া। মনে পড়ে আলবত, কেঁদে ককিয়ে কেনা দুটো-একটা বই-এর কথা। লিটল ম্যাগাজিনের কথা। সত্যিই মনে পড়ে, পুরাতন ছাপাখানা, ট্রেডল মেশিনের গোঙানি, ভিজে কাগজে তোলা নিজের প্রথম লেখার বানান ভুলে ভরা প্রুফের বান্ডিল। আরও মনে পড়ে প্রুফ দেখতে শেখার শিক্ষানবিশির দিনগুলি, সাংকেতিক চিহ্নগুলি। খুব আনন্দ হত যে; আর আনন্দ যেখানে, মন-প্রাণে সঁপে দেওয়া সেখানে—কে না জনে?

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন করতে শুরু করি—পরিত্যক্ত, অকেজো ফোনে। কতদিন আগে সংগ্রহ করা নাম্বার। দু’একটা লেগেও যায়। কিন্তু কেউ কিছুই যে বলতে পারে না, মুখে কিন্তু বলে—‘সব  মনে আছে, বলছি’। তোমার কাছে আছে তড়িৎ, সেই পুরোনো ‘প্রতিবিম্ব’র সংখ্যা’? আছে। আছে আছে। তারা দিতে পারে না কিছুই। দিন, তারিখ, স্থান—প্রথম সংখ্যা প্রকাশ কীভাবে হলো— বলতে পারো অচিন্ত্য? অবশ্যই পারি, সংখ্যাটা দিচ্ছি, দেব, পাঠাবই। তারা দিতে পারে না কিছুই। আমি ঠায় বসে থাকি। দিন যায়। প্রদীপ, তুমি বলতে পারো প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ কীভাবে এঁকেছিলে? খবর পাই, প্রদীপেরই কোনো খবর নেই, সে কোথায়? কেউ বলতে পারে না। তাহলে কীভাবে লিখি পুরোনো সেই দিনের কথা?

পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কেউ কথা রাখেনি। কেউ কিছু বলেনি। আমি অবশেষে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাবা-মায়ের দেওয়া যে কালো ট্রাঙ্কটি বয়ে চলেছি মাথায় নিয়ে, যাযাবরের মতো বহন করেই চলেছি, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে, এ-বাসা থেকে ও-বাসায়, অবশেষে তার শরণাপন্ন হই। 

তাকে আমি যে নিয়মিত পরিষ্কার করেছি, মুছেছি, তুলে রেখেছি, সাজিয়েছি সযত্নে। পুরাতন ন্যাপথলিনের গন্ধ সরিয়ে আমি খুঁজে পাই একটা খাতা। রুল টানা, হলুদ হয়ে আছে, ভঙ্গুর হয়ে আছে সে খাতা। গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সে ঝড়ে পড়ছে। অত বড়ো খাতায় কোনো এন্ট্রির চিহ্নই নেই। কেবল একটি পাতায় লেখা কয়েকটি বাক্য। একটি তারিখ, একটি সময় এবং একটি জন্মের কথা। একটি স্থানের কথা, ব্যস, আর কিছু নেই। টানা তেতাল্লিশ বছর ধরে একটানা নিষ্ঠুর শূন্যতা। হলদে পাখিটি যেন হঠাৎ ফেলে গেছে এক ধূসর পালক।

বলা নেই, কওয়া নেই, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খাতা কলম নিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে চার লাইনের এই ছড়াটা লিখে ফেললাম। অবশ্য দীর্ঘশ্বাস সহ। শোনাতেই হবে বিকেলবেলার আড্ডায়। নিজের লেখা কিছু একটা—হোক না তা সাপ বা ব্যাং। অর্থাৎ ইতোমধ্যেই আমরা গড়ে নিয়েছি এক সংঘ, যারা শরীরচর্চা, সমাজসেবা বা পাড়া-সেবা না করে সাহিত্য আর শিল্পের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে চায়। শিল্পের সংজ্ঞা, ধর্ম বা সংকট না জেনেই। প্রতি রবিবার বিকেলে সেই গোপন আস্তানায় নিয়মিত চলতে থাকল গান, ছবি আঁকা আর সাহিত্যের চর্চা। অনেক অনেকদিন এলোমেলোভাবে ঘুরাঘুরি করে যেন পাওয়া গেল উদ্দেশ্যের অস্পষ্ট ঠিকানা। খোসবাগানের এক পরিত্যক্ত বাড়ির খালি পড়ে থাকা দোতলায় বসে আমরা নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে যে যা পারি তাই লিখি, পড়ে শোনাই, নিজেরাই হাততালি দিই।

একদিন অখিলেশ পড়ে গেল কবিতা আর তার শেষ লেখা গল্প ‘আর এক স্বর্গের মৃত্যুতে’। আজও মনে পড়ে তার মুখ মাঝে মাঝেই, যেন কেউ এঁকে দিতে বললে এখনো এঁকে দিতে পারি। তুমি এভাবে চলে গেলে অখিলেশ? ওই বাড়িতে সত্যিই এক ময়ূর ছিল, যে ঘুরে বেড়াত একা একা ছাদের কার্নিশে-কার্নিশে। আমাদের নাটের গুরু নিখিলেশদা—নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশের দাদা। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর  দর্শন পড়েন। ছবি আঁকেন নিজস্ব স্টুডিয়োতে, তেঁতুলতলা বাজারে। গল্প, কবিতা লেখেন। শহরের তাবৎ বুদ্ধিজীবীকে দাদা সম্বোধনে ডাকেন অবলীলাক্রমে। আমরা তাঁর পিছু ছাড়ি না। তাঁকে উপদেষ্টার আসনে বসিয়ে আমরা করি নাটক লিখি গল্প-কবিতা, আঁকি ছবি। হঠাৎই একদিন নিখিলেশদা ঘোষণা করলেন, একটা পত্রিকা চাই। শুধু লিখলে হবে না, পাঠককে তা পড়তেও হবে। মিনিবুক-এর আকারে জন্ম নিল আরও একটি নিরুপায় সাহিত্য প্রয়াস। প্রতিবিম্ব।

মিনিবুকের তুলো তখন উড়ছ সর্বত্র-কলকাতা ছাড়িয়ে বর্ধমান, বীরভূম…। বিপ্লব স্পন্দিত চারিদিকের বারুদের মাঝে লাল রং-এর কভাবে মোড়া প্রতিবিম্বই ছিল আমাদের পোঁতা টাটকা গোলাপের চারা। গল্প, কবিতার রং-এ চুবিয়ে আমাদের প্রচ্ছদগুলিতে থাকত সরল নিষ্পাপ  শুকনো বিপর্যস্ত মুখগুলোর মাঝে একটা প্রতিবাদের হাত। এঁকে দিত প্রদীপ বিশ্বাস—আমার প্রথম শহুরে  সুহৃদ, যার নিরন্তর সাহচর্যে আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম শিল্পের মহিমা। পরের দিকে কখনো-কখনো আরও পরিশীলিত হাতে এঁকে দিতেন সমরদা, সমর মুখোপাধ্যায়, বা তারও পরে রূপক মিত্র তার বিনীত হাতের লিনোকোটে। সবাই লিখেছে তখন—তড়িৎ মুখোপাধ্যায়, নিগমেশ  বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও কতজন। ছাপা হয়ে যাচ্ছে প্রতিবিম্ব অনিয়তমতো ভাবে নিয়মিত—বড়ো কোনো প্রত্যাশা নেইস, কলকাতার খবর রাখি নাম বাসনাও নাই কারুর লেখক হবার।

উদয়চাঁদ গ্রন্থগারে বই দেওয়া-নেওয়া হয়। তখন জেলা গ্রন্থাগারগুলি ছিল প্রকৃতই গ্রন্থের খনি, আমাদের হাত-বাড়ালেই বন্ধু। নিজেরাই লিখে, নিজেরা পড়ে, শহর চষে বেড়াই—আর কে লিখছেন,  পত্রিকাই বা বের করেন কারা—তাঁদের খোঁজ করি। চাই ছোটো কাগজ, ছোটো অখ্যাত লেখক আর  ছোটো সম্পাদক। আমরা সন্ধান পাই ইন্দ্রনীল মজুমদারের। ‘টিপ’ পত্রিকার সম্পাদক। আমাদের আমন্ত্রণে এলেন, পড়লেন ‘জীবন যেখানে’— ‘কবরে মুখ রেখে ঘাসে মুখ সেখে বলতে ইচ্ছে করে— জীবন এই’ —তাঁর নিজস্ব কাব্যিক ঢং-এ। প্রতিবিম্ব-য় লিখলেন ‘প্রবীণ সারস’ নামে  শিক্ষক হিসেবে এক ব্যক্তিগত  অনুভূতির কথা। তাঁরই সঙ্গে এলেন ইংরেজির তরুণ অধ্যাপক স্বপন বন্দোপাধ্যায়, অনুবাদ করেন বিদেশি কবিতা ।

ওদিকে ‘জয়ধ্বনি’ বের করছিলেন নীহার বাগ, গৌর পালিত, বলরাম পাল, শম্ভু বাগ, নিগমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিদিবিন্দু সেন। নিজেদের লেখা কম ছেপে তাঁদেরও লেখা চাইলাম। বুদ্ধদেব বসুর অন্তরঙ্গ কৃতী ছাত্র কমলেশ চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান রাজ কলেজে পড়ান। আমরা লেখা চাইলাম আমাদের মাস্টারমশাই লেখকদের কাছে কুণ্ঠার সঙ্গে। চিত্ত ভট্টাচার্য, কামাখ্যাচরন মুখোপাধ্যায়, শেখর সেনগুপ্ত, আর সুধীরচন্দ্র দা—চারজনেই লিখতে থাকলেন গল্প, কবিতা, অনুবাদ। চিত্ত ভট্টাচার্য প্রতি বছর পুজোর সময় ‘আশ্বিন’ নামে সাহিত্যের এক সংকলন প্রকাশ করতেন। তখন আমাদের সামনে  আশ্বিন-ই উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন । বাছা বাছা লেখার সমৃদ্ধ, বছরে একবার প্রকাশিত হতো। কলানবগ্রামের রণজিৎ ভট্টাচার্য লিখতেন তাতে ভালো গল্প।

চিওবাবুর সহধর্মিণী চিন্ময়ী ভট্টাচার্যও ওই সময় লিখছেন গল্প। আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমরা প্রায়ই যেতাম ওঁদের বাড়িতে। কামাখ্যাবাবু লিখতেন প্রবন্ধ, কবিতা। সুধীরবাবুর (আমার ছোটো মামা) ছোটো গল্পের হাত তখনই বেশ মজবুত। প্রতি বছর বের করতেন তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিজয় তোরণ’-এর চমৎকার শারদ সংকলন। আমরাও সবাই লিখতে শুরু করি ওই সংকলনে। প্রকৃতপক্ষ এই ‘বিজয় তোরণ’ প্রকাশের মধ্যে দিয়েই আমাদের প্রুফ দেখা, সম্পাদনার হাতেখড়ি। শেষ দিকে আমারই দায়িত্ব ছিল ওই পত্রিকার শারদসংখ্যা আর নিজস্ব ছাপাখানাটি দেখাশোনার। কতজন আসতেন সে সময় ওই দপ্তরে লেখা দিতে, আড্ডা দিতে। মানবেন্দ্র পাল, প্রবোধ রাউত, রণজিত ভট্টাচার্য, শেখর সেনগুপ্ত—বিবেকানন্দ আর্ট প্রেসে বিজয় তোরণের কার্যালয় তখন থাকত সবসময় ব্যস্ত। শ্যামাপ্রসাদ কুন্ডুর ‘ভাবনাচিন্তা’—এসবেরও আমরা খোঁজ নিই, পড়ি  নিয়মিত ।

কবি কে? রূপক মিত্র আবার কে? আজকের রূপক, আর আগের রূপক একেবারে একরকম। সারাদিন-রাত টো টো করে বর্ধমান ঘুরে বেড়ায় আর লুকিয়ে লেখে— যা মন চায়। প্রথমে ‘চয়ন’, ‘অনিকেত’ পরে ‘অক্ষর’, তারপর ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ যখন যে নাম পায় তাই দিয়ে কাগজ বের করে। অমিতাভ মল্লিক, পার্থসারথি মল্লিক, মিহির চক্রবর্তী, শ্যামলেন্দু সরকার, চন্দ্রনাথ শেঠ, মলয়কুমার সাঁই, অভিজিৎ রায়, সেখ সেলিম, সুভাষ চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত হাজরা চৌধুরী, দেবশিস চৌধুরী, রাণা সেনগুপ্ত, জ্যোতির্ময়, বরুণ, স্বপন—এরা এক-একজন এক-একবার সম্পাদক। একটু পরে  আরও কয়েকটি ছোটো কাগজ বেরোতে শুরো করেছে বর্ধমান থেকে। শ্যামলাবরণ সাহার ‘বাল্মীকি’, প্রকাশ দাসের ‘স্বকাল’, রাজকুমার রায়চৌধুরীর মনসিজ, দেবেশ ঠাকুরের প্রমিথিউস, সনৎ মণ্ডলের দ্বৈপায়ন, নীলা করের কোমল দূর্বা, দেবাশিস চৌধুরীর কফিন। আর ছিল ধীরেন সুরের নিয়মিত কাগজ ছোটদের কথা’। কোমল দূর্বা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দূর্বা নামে। তৃপ্তি মিত্রর লেখা গল্প ও অন্যান্য লেখা 

২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত প্রত্যেক বছর একটি করে সংখ্যা অবশ্যই প্রকাশিত হয়ে প্রতিবিম্ব অনিয়মিতভাবে এখন ‘নিয়মিত’ আখ্যা পেয়েছে, বলাই যায়। কলেবরও ধীরে ধীরে কিছু বাড়লেও সর্বদা মাথায় রেখেছি দু’শো পাতার বেশি যেন কখনো না হয়। আমার একেবারে ব্যক্তিগত ধারণা প্রথম ছিল—লিটল ম্যাগাজিন ১০ ফর্মার বেশি হলে, কেমন যেন লাগে। সেই নীতিকে সামনে রেখে কখনো পত্রিকার আকারকে অতি-ঢাউস করে তুলিনি। আর কতকগুলো অলিখিত নীতি সর্বদা অনুসরণ করেছি। যথাসাধ্য তা পালনও করি। এগুলো অবশ্য আমার ব্যক্তিগত নীতি।

ক. পত্রিকা প্রকাশে কোনো বন্ধুকৃত্য না-করা। বন্ধুদের কেউ কেউ কখনো-বা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্টই হয়েছে। কিন্তু আমি নিরুপায়।

খ. উল্লেখযোগ্য বিষয় এবং লেখা পেলে তবেই পত্রিকা প্রকাশ। নচেৎ কিছুতেই না।

গ. প্রতিবিম্ব মূলত গদ্যের কাগজ, কিন্তু কবিতাকে উপেক্ষা ক’রে নয়। কবিতা অবশ্যই থাকবে। তার বিশেষ এক সুগন্ধ থাকবে সারা পত্রিকাজুড়ে ।

ঘ. কবিতা ছাড়া পত্রিকাকে সর্বদা অসম্পূর্ণ মনে করেছি। এই পত্রিকার লেখা আমি সর্বদা লেখকদের কাছ থেকে চেয়ে নিই। দেখেছি ডাকে পাঠানো কোনো লেখাই এখন পর্যন্ত আমার কাছে উৎকৃষ্ট মানের মনে হয়নি ।

ঙ. রাস্তাঘাটে কফিহাউসে আড্ডাখানায় পকেটে আমার হাতে লেখা দিয়ে দেওয়া—সবচেয়ে অপছন্দের ।

চ. বারবার তাগাদা দিয়ে যাঁরা লেখা দেন, দেখেছি সেই লেখাগুলি আমার বেশি পছন্দ হয়।

পঞ্চাশটা বছর কখন চলে গেল, এখন মনে হয়, বুঝতেই পারলাম না। মনে হয় কেবলই তো সেদিন—প্রখর রৌদ্রে একটা ভাঙা সাইকেলে পা দিয়ে আমি বর্ধমানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি, হাতে প্রুফের তাড়া। একটা দশটাকার বিজ্ঞাপনও যদি পাওয়া যায় শেষ মুহূর্তে। মনে পড়ছে, প্রতিবিম্বর হাত ধরে একসময় এলাম কলকাতা। ‘ব্যবসা-বাণিজ্য’ প্রেসে পত্রিকা ছাপতেই হবে, কেননা, এক্ষণ ছাপা হয় ওখানে যে। অতীব দুঃখের কথা, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য’-য় একটি সংখ্যা ছাপতে দিয়ে তা শেষপর্যন্ত কিছু ছাপা হয়েও আর সে সংখ্যা বেরোল না। পত্রিকা সাময়িক বন্ধ হয়ে গেল। কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের তত্ত্বাবধানে যদি একটি সংখ্যা বের করা যায়, তা হবে নির্ভুল এবং যথাযথ, এই ভেবে একবার একটি সংখ্যার ‘অধুনা’য় ছাপা ও বাঁধাই হয়ে যাওয়ার পর পত্রিকা হাতে নিতে গেছি নিজে। তার পর কী হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি করছি না। আগেই উল্লেখ করেছি।

এমন কত ঘটনা পেরিয়ে আজ পঞ্চাশ বছরে এসে পৌঁছেছে একটি ছোটো পত্রিকা। বড়ো বড়ো পত্রিকার সম্পাদকরা আড়চোখে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেমন তাচ্ছিল্য করেছে, আবার সমীহ করে অতীব যত্নে এই পত্রিকা হালে তুলে নিয়ে লেখকদের সযত্নে তুলে রাখতেও দেখেছি তাঁদের বুক সেলফে। উপেক্ষা আর প্রশংসা দুইই সমানভাবে পেয়েছি এই পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে। ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর লেখা চূড়ান্তভাবে সম্পাদনা করে যখন ছেপেছি, সে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছে হয়তো। ছাপার পর আবার তার ভুল বুঝতে পেরে সাদরে গ্রহণ করেছে এই পত্রিকা।

বাণিজ্যিক সাফল্য কখনোই পাইনি এই পত্রিকা প্রকাশে। কখনো না। আবার সর্বদা যে নিজের পকেট থেকে সর্বস্ব দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেছি তাও সত্য কথা নয় আদৌ। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ বছরের এই পথ মসৃণ না থাকলেও বড়ো বড়ো বাধার সম্মুখীন হইনি কখনো। কীভাবে যেন হয়ে গেছে সব। আমার ধীর স্থির স্বাভাবিক সচল জীবনটার মতো। হ্যাঁ, সম্পাদনা করতে গিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা হলো আমার নিজের লেখার। লেখার সময় পাইনি বা লেখায় মনোনিবেশ করতে পারিনি। দায়িত্বপূর্ণ চাকুরি এবং সংসার প্রতিপালন করে এই সম্পাদনাকর্ম পরিচালনা আমাকে করতে হয়েছে। আমার নাই বা হলো লেখক হওয়া। 

এই পঞ্চাশ বছরে পঞ্চাশটিও সংখ্যা প্রকাশ করতে পারিনি। আমার অঙ্ক কষে লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যার হিসেব রাখি না। ওসব রাখুক অক্ষম পিঁচুটি নিয়ে ঘোরাফেরা করা সমালোচকরা। তবে গলা তুলে বলতে পারি—প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের পাঠকরা সাদরে প্রতিবিম্ব-কে গ্রহণ করেছে। প্রতিবিম্বর জয় এখানেই। লিটল্ ম্যাগাজিনের পবিত্র চরিত্রটি বজায় রাখার চেষ্টা করেছি সর্বদা। কেউ টলাতে পারেনি। লেখকের বয়সে নয়, লেখার তারুণ্যে সর্বদা টগবগ করেছে ‘প্রতিবিম্ব’ স্বধর্মে থেকে। 

এতদিন পর সত্যিই আজ মনে হচ্ছে—এবার বন্ধ হোক সম্পাদনাকর্ম। এই সংখ্যাটিই হোক শেষ সংখ্যা। প্রতিবিম্বর প্রণম্য পাঠকরা কী বলেন।


প্রশান্ত মাজী  সম্পাদক এবং কথাসাহিত্যিক। সম্পাদিত ছোটকাগজ প্রতিবিম্ব। ২০২২ সালে কাগজটি ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। ছোট কাগজের ইতিহাসে যা অনন্য। প্রকাশিত গ্রন্থ : নয়য়ের অধিক, হলুদ পোস্টকার্ড (গল্পগ্রন্থ)। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। 

menu
menu