`মননরেখা’য় ফিরে দেখা : উত্তরবঙ্গে দেশভাগ

ক’দিন আগেই বের হলো মননরেখার ‘উত্তরবঙ্গে দেশভাগ’ সংখ্যা। এবছর দেশভাগ যখন ৭৫ বছরে পড়ল, বাংলা প্রকাশনায় এমন একটি কাজ বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দাবি রাখে। সংখ্যাটি হাতে নিলে বোঝা যায়, মননরেখা এই যুগসন্ধিক্ষণকে মাথায় রেখে বেশ সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিতভাবে দেশভাগের অনুসঙ্গগুলো হাজির করেছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের পাঠকদের নানা প্রতিক্রিয়া এবং এই সংখ্যা হাতে পাওয়ার জন্য বেশ আগ্রহের কথা জানা যাচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, উনিশশো সাতচল্লিশের অপরিণামদর্শী বিভাজনের আলাপটা শেষ হয়ে যায়নি। মানুষ এখনো তার উৎস ও নেপথ্যের কার্য-কারণকে জানতে চায়। প্রমাণিত হয় যে, গত সাত দশক থেকে ভাগাভাগির ওই কালো অধ্যায়কে যত কৌশলেই ঢেকে রাখা হোক না কেন মানুষের মন থেকে তা মুছে ফেলা যায়নি। আসলে, সেই বেদনার অস্তিত্বকে মুছে দেয়া যায় না। উপমহাদেশের যাপিত জীবনে সাতচল্লিশের অভিঘাত নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। এর প্রভাব ও পরিণাম সুদূর প্রসারী। 

দেশভাগ নিয়ে বিগত দিনে উভয় বাংলাতেই অনেক কাজ আছে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও এর চর্চা বিদ্যমান। দেশভাগের প্রায় আট দশক পর মননরেখাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করল—তাদের কাজে স্বতন্ত্রতা লক্ষণীয়। এই সংখ্যার পাঠ পর্যালোচনায় প্রবেশ করার শুরুতেই জানা যায় যে, মননরেখা তার দেশভাগের আলোচনা-অনুসন্ধানে উত্তরবঙ্গকে যুক্ত করেছে। এজন্যেই এটি আগ্রহী পাঠকদের কাছে আলাদা মনযোগ পেতে পারে। বিষয়টি অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অনুসন্ধান এমন এক ভৌগলিক কাঠামোকে নির্দিষ্ট করেছে, সাতচল্লিশে সিরিল রেডক্লিফ যার হৃদয়কে টুকরো করেছে। রেডক্লিফের উদ্ভট সীমান্ত বিভাজনরেখায় উত্তরবঙ্গ খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। তার হৃদয় থেকে রক্তপাত ঘটেছে। রাতারাতি পরস্পর পরস্পরের দুশমনে পরিণত হয়েছে একদা বাংলার উত্তর জনপদের একই সমাজে বাস করা শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। আর সব কিছুকে এক নিমেষে খারিজ করে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয় হঠাৎ করেই চড়াও হয়েছে মাথার ওপর। পারস্পারিক অবিশ্বাস, হানাহানি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তাদেরকে স্থায়ীভাবে পরিচয়হীন, উন্মূল ও কক্ষচ্যুত করেছে। সামাজিক বন্ধনের ভিত নড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দেশভাগে বাংলার উত্তর জনপদের প্রকৃতির বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হয়েছে, মানুষ হারিয়েছে তার বাস্তুভিটা, জীবন-জীবিকা। মোটকথা উত্তরবঙ্গই দেশভাগের প্রধানতম শিকার। বাংলায় দেশভাগ মানেই উত্তরবঙ্গ ভাগ।

বই, চলচ্চিত্র, গানে, ছবিতে দেশভাগ নিয়ে এত আলাপ, এত বিশ্লেষণ অথচ উত্তরবঙ্গ সেই আলোচনার কেন্দ্র তো দূরের কথা, পরিধিতেও জায়গা পেল না কেন—এ এক বিস্ময়। অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হয়, ইতিহাসচর্চার প্রচলিত গৎবাঁধা রীতির খোলনলচে বুঝি পাল্টানোর সময় হয়ে গেছে। যাক অন্তত আশার কথা যে, কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান না হয়েও এমন একটি কষ্টসাধ্য, অনুসন্ধানী সংকলন প্রকাশে সাহিত্য ষাণ্মাসিক মননরেখা যে নিষ্ঠা ও সাহস দেখিয়েছে, তা বিস্ময়কর। এজন্য শুধু ধন্যবাদ নয়; কর্তব্য হবে পাশে তার দাঁড়ানো। কারণ, আমাদের দেশে লিটলম্যাগ বা সাহিত্য পত্রিকাগুলোর পথচলা অনেক সংগ্রামের, কষ্টের—তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। এমন কি তাদের বরাতে স্বীকৃতিও জোটে না। অথচ সাহিত্য-সংস্কৃতি গবেষণা-চর্চার নামে সরকারি-বেসরকারি অর্থের হামেশা অপচয় হয়। অথর্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠিন দেয়াল নিজেদের অপরাগতা ঢাকতে পথ আটকে রাখে। বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তথাকথিত অগ্রসর চিন্তার কাগজে তাদেরকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়, তাদের সংবাদ ছাপা হয় না। এতকিছুর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে লিটল ম্যাগগুলো শিল্প-সাহিত্য চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও আরও মৌলিক রাখবে এমনটি আশা করা অমূলক নয়। বর্তমান বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন এমনই আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো এই বিকল্প প্রয়াসই হবে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মূলধারা।  

মননরেখার ‘উত্তরবঙ্গে দেশভাগ’ সংখ্যাটি সাড়ে ৫ শতাধিক পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের, এর উপস্থাপনবৈচিত্র্যও ব্যাপক। লিখিত ইতিহাস ও প্রত্যক্ষ বয়ান—দু’দিকে থেকেই উত্তরবঙ্গে দেশভাগ অনুসন্ধান দৃশ্যমান। তবে সাধারণভাবে দেশভাগের বয়ানও আছে। মোট ১১টি সেকশনে বিভক্ত এই সংখ্যায় ৩০টি প্রবন্ধ রয়েছে যাতে নানাদিক থেকে উত্তরবঙ্গে দেশভাগের অভিঘাতকে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ মিলে উত্তরবঙ্গ বিশাল এক ভৌগলিক অঞ্চল। সম্পাদক স্বীকার করেছেন এবং আমরাও জানি যে, সব এলাকাকে এক মলাটে উপস্থাপন করা দুঃসাধ্য। তাই এক্ষেত্রে মননরেখার সম্পাদনার নীতি ছিল সীমান্তরেখা ধরে এগিয়ে যাওয়া এবং নির্বাচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে তুলে ধরা। এই সম্পাদনার নীতি বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। উত্তরবঙ্গের অতীত ইতিহাস, এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে দেশভাগের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা-বিশ্লেষণ রয়েছে। যোগাযোগ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে আলাদা আলোচনা অনুসন্ধান। এই সংখ্যায় চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এর সঙ্গে রয়েছে দেশভাগের চলচ্চিত্র নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। সাতচল্লিশসৃষ্ট ক্ষত নিয়ে এখনো যারা বেঁচে আছেন তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া দুর্লভ। আবার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তাঁদের অনেকেই সেই কালের ঘটনাবলীকে সচেতনভাবে ধারণ করেন না। তবু সম্পাদককে সাধুবাদ জানাতে হয় যে, দেশভাগকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সদস্য এমন ৪ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার যুক্ত করেছেন যাঁদের এমন কিছু বয়ান রয়েছে যা লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। এটি অনেক বুদ্ধিদীপ্ত ও সক্ষম সম্পাদনার পরিচয় বহন করে। এবং অবশ্যই এই সংখ্যার সবচেয়ে মূল্যবান দলিল। 

দেশভাগ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক কূলদীপ নায়ার—সেটি পুনর্পাঠের জন্য ছাপা হয়েছে। স্মৃতিচারণ করেছেন কথাসাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের কন্যা এণাক্ষী মজুমদার একদা যাঁরা পাবনা থেকে দেশান্তরী হয়েছিলেন। এছাড়া উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতিতে দেশভাগের প্রভাব নিয়ে রয়েছে কয়েকটি সুখপাঠ্য লেখা। 

সম্পাদক স্বীকার করেছেন, দেশভাগে উত্তরবঙ্গে সৃষ্ট অভিঘাতসমূহকে যথাযথভাবে খুঁজে বের করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। উত্তরবঙ্গ বরাবর অবহেলিত-উপেক্ষিত। দেশভাগের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ পরিণতি ভোগ করলেও—তথ্য-পরিসংখ্যান তার উল্লেখ নেই বলাটাই শ্রেয়। এ বিষয়ে খোদ সরকারি নথিপত্রও দুষ্প্রাপ্য; অনুপস্থিত বললেও অত্যুক্তি হবে না। এসব প্রতিকূলতার মাঝেই মননরেখা উত্তরবঙ্গের ধূলোমলিন দেশভাগ অধ্যায়কে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। ইতিহাসের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করে উপস্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছে। তাই সব মিলিয়ে মননরেখার এই সংখ্যা উত্তরবঙ্গের দেশভাগের প্রভাব অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইলো। সংখ্যাটির প্রচ্ছদচিত্র এঁকেছেন খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রকর গণেশ হালুই। লেখা, প্রচ্ছদ ও ঝকঝকে মুদ্রণ—সব মিলিয়ে শেকড়সন্ধানী সকল গবেষক ও পাঠকদের এই সংখ্যাটি সংগ্রহ করা উচিত।

মননরেখা, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ষান্মাসিক, সম্পাদক : ড. মিজানুর রহমান নাসিম, প্রচ্ছদ : গণেশ হালুই, দাম : পাঁচশত টাকা। 


খোকন দাস গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামই তার লেখার বিষয়বস্তু। প্রকাশিত গল্পের বই : কাক ও অন্যান্য গল্প, খড়ের মানুষ

menu
menu