শেকল ছিঁড়ে তুলে আনা রূপালি ঝিনুক


‘কবিকে কবির মতোই থাকতে দাও। অথচ তার পায়ে
পরাচ্ছ শেকল আর এঁকে দিচ্ছ চকখড়ি-বৃত্ত—বলছো
বৃত্তের ভেতরেই তোমার পরিক্রমা।’
(কবি : নানা রঙের প্যারাশুট)

কবি এক বাঁধনছেঁড়া পাখি। কবিকে খাঁচায় বন্দি রাখা যায় না। যতই বৃত্তবন্দি করে রাখার চেষ্টা করা হয় ততই কবি বৃত্ত ছিঁড়ে হয়ে যান মুক্তপাখি। এ্যাকুরিয়ামে মাছের জীবন কবি দেখেন আর বিধ্বস্ত হন। বন্দিত্ব যে কতো কঠিন ব্যারাক কবি উপলব্ধি করেন অন্তরতম বেদনায়। কবির স্বাধীনতা কবির চিন্তা কবির বিশ্বাস কবির লালনভূমি লালচোখের সীমায় কখনও বন্দি করা যায়নি। বৌদ্ধসিদ্ধার্থ চর্যাপদের কবিরা স্বাধীনচিন্তায় স্বাধীনভাবে পদচর্চা করেছেন, খনার জিহ্বা কেটেও তাঁকে পরাধীন করতে পারেনি রাজা। মধ্যযুগেও কবিরা সংগ্রাম করেছেন কবিতায়। আধুনিক যুগে সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন কবিরা। কবি তমিজ উদদীন লোদী তাঁর যুগে এসেও সেই একই কথা বলেছেন আধুনিক কাব্যভাষায়।

‘কবিরা নিথর পানির উপর দাঁড়িয়েও শুনতে পারে জলের কল্লোল
ঘুমন্ত আগুনকেও কবিরা উসকে দিতে জানে। নীলিমার
বিলোড়নের ভেতরে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হাসি আর চুম্বন নিয়ে আসতে
পারে একমাত্র কবি-ই।’
(কবি : নানা রঙের প্যারাশুট)

অসীম সাহসী কবি ছাড়া আর কে শুনতে পারে নিথর পানিতে জলের কল্লোল? নীলিমায় দিতে পারেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হাসি আর চুম্বন? কবির ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী। কবি আর কলম মিলে তৈরি করেন কালজয়ী শব্দকামান। কবির হাতেই নির্মিত হয় আইফেল টাওয়ার। কবিই সেই স্বপ্ন গ্রন্থিত করেন বিজ্ঞান-খামারে। আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলেন ক্ষয়ে যাওয়া সমাজবিস্তারে। হৃদয়ের আকুতিতে ঝরে পড়ে কালের মহাকালের লৌকিক-অলৌকিক ঝর্ণাধারা। কবি বাস্তবের মানুষ হলেও তাঁর মনোচিন্তা-মনোবেদনা-মনোবাসনা-মনোযন্ত্রণা সাধারণকে ছাড়িয়ে অসাধারণ, অপার্থিব। তাই কবিকে কখনো বন্ধনবৃত্তে আবদ্ধ রাখা যায় না। কবি বন্ধনহীন কুমারীর বেণী। শেকড়ছেঁড়া পদ্মার ইলিশ। অরণ্য-স্বাধীন মৃগ-হরিণ। হাওয়ায় উদ্বেলিত ঊষার আলো। নারীর কল্লোলিত যৌবন। আত্মার অপরিসীম স্রোতস্বিনী-শ্রোতা। অকুল দরিয়ার অশান্তপোষা চঞ্চল প্রাণ। কবিরা এমনই; কবিতা-ই তাঁর সন্তান। তাই তো কবি তমিজ উদদীন লোদী বলে ওঠেন—

‘কবিরা পৃথিবীর বুকে সৌরভের মতো। অশ্রুস্তব্ধ কোনো
বিকেলে কবিকে শেকল পরাতে যেয়ো না। কবিকে কবির 
মতোই থাকতে দাও।’ (কবি : নানা রঙের প্যারাশুট)

মানুষ চিরকালই বন্দি। আর কারও কাছে বন্দি না হলেও হৃদয়ের খুপড়িতে সে বন্দি। শোকে-দুঃখে, সীমাবদ্ধ আচ্ছন্নতায় মানুষ বন্দি। কিংবা পূর্বপুরুষদের অন্ধ-কুসংস্কারে বন্দি। সেই বন্দিত্ব থেকে উঠে আসার নির্ভয় সাহস দিতে পারেন কবি। চারদিকে ক্লেদাক্ত রোধির পেরিয়ে, চারদিকের চিতা, গোরস্থান, চিতাভস্ম কালোধ্যায় পেরিয়ে কবি বলতে পারেন ‘তবু তুমি উঠে আসো’। কবি তমিজ উদ্দীন লোদী ‘অলৌকিক আশার ভঙ্গিতে’কবিতায় এমনই আশার কথার বলেছেন। কবি বলেন— 

‘এক জীবন্ত জ্যোতির্বলয়ের ভেতর তুমি নড়ে ওঠো
তোমার গলায় ঝোলে শেকল
যেন এক অরণ্যে অনধিগম্য আঁধারে বন্দী
পাখি এক ডানার ধিক্কারে প্রকম্পিত করছে হাওয়া
তোমার চারদিকে চিতা, গোরস্থান আর শবাধার
হাওয়ায় শব্দের গন্ধ, চিতাভস্ম 
ভৌতিক আচ্ছন্নতায় ডুবে যায় নদীর কলস্বর 
হাওয়ায় সিম্ফনি
তবু তুমি উঠে আসো।’ 
(অলৌকিক আশার ভঙ্গিতে : নানা রঙের প্যারাশুট)

কবি স্বপ্নকে হাতে ধরে সকাল-সন্ধ্যায় হেঁটে যাচ্ছেন নীলিমার দিকে, হৃৎপিণ্ডের দিকে, হৃদয়ের দিকে। কবি আছেন প্রার্থনার ভাষায়, নদীর সংগীতের সঙ্গে, নদীর কল্লোলের সঙ্গে, জলের সৌন্দর্যের সঙ্গে। কবি অন্ধকার সরাতে সরাতে এগিয়ে যান বিপ্লবের দিকে। এরকম একটা গভীর ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি ‘চলেছো নীলিমার দিকে’ কবিতায়। অতঃপর কবি বলছেন—

‘তুমি যাচ্ছ বুননের দিকে, পরিতৃপ্ত ও আশ্লেষের দিকে
আবিষ্কার ও বিকাশের, উদ্যম ও বিপ্লবের দিকে
 প্রেরণায়
       সাহসে
              অন্ধকার সরাতে সরাতে 
তুমি যাচ্ছ আত্মমোচনের দিকে।’ 
(চলেছো নীলিমার দিকে : নানা রঙের প্যারাশুট)

কবি নারীকে দেখেছেন ‘সমুদ্রে সূর্য ডুবে যাওয়ার মতো—আমিও ডুব দিই তোমার চোখের রেটিনায়’। নারীর কাছেই পুরুষের জাগতিক আত্মসমর্পণ। পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য খুঁজে ফিরেন নারীর নাব্যতায়। একজন কবির কাছে এই নারী কবিতার এক অনিবার্য উচ্চারণ। নারীর মাধ্যমেই কবি ঝড় তুলেন কবিতায়। বাতাসে অবগাহন করে কবি খুঁজে বেড়ান দীঘল চুলের মায়াবী গন্ধ। সাগরের ঢেউয়ের মাঝে প্রিয়তমার উন্মাতাল সাঁতার। নারীর দেহ-মাধুর্যে কবির বিপ্লব রূপ লাভ করে শক্তি ও সাহসে। কবি তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়—  

‘তোমার স্থিতধি চোখ, ঠোঁট ও দাঁতে
 কোথা থেকে যেন এক আনন্দের রেণু ছুঁয়ে যায়
 তোমার চোখে অজস্র তারাবাতি
 তোমার ঠোঁটে আনন্দের চুমো আর
 তোমার দাঁতে অসংখ্য বিজলী চমক।’ 
(সমুদ্র, নারী ও একটি প্রিজম : নানা রঙের প্যারাশুট)

অথবা,

‘বাতাসে ভাসতে থাকুক ধুলো ও কয়লার গুঁড়ো
রুখে উঠুক ঝড়
যদি যাই 
বিপ্লবের মূলমন্ত্র তোমাকেই বলে দিয়ে যাব।’ 
(যদি যাই : নানা রঙের প্যারাশুট)

প্রকৃতির সৌন্দর্যে নারী-স্বরূপ এগিয়ে আসে সমুদ্র। কবি কক্সবাজার গিয়ে সমুদ্রের ঢেউজলে সেই নারীকেই কবি উপলব্ধি করেন সৌন্দর্যের শোভাময় সমুদ্রলীলায়। নারী যেন সাঁওতাল রমণী উঠে এসেছিল পুষ্পসাজে। নারী তখন উপমা হিসেবে ধরা দেয় কবির কাব্যচিন্তায়— 
‘তোমার ওষ্ঠের মতো লাল সূর্য ডুবে গেলে
রোমান্টিক নৌকোর মতো উঠে আসে চাঁদ
গলে যায় চাঁদ জ্যোৎস্নারূপ জলের ভেতর।’ 
(কক্সবাজার : চাঁদ জলের বিভ্রম : নানা রঙের প্যারাশুট)

অথচ সেই নারীকে কবি পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়ে বলেছেন— 

‘যেখানে অশ্রুমোচন করে সেজদায় আনত হয়েছিল
পৃথিবীর প্রথম পুরুষ ধরণীর প্রথম রমণী।’ 
(প্রকাশিত নৈঃশব্দের ভেতর : নানা রঙের প্যারাশুট)

কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর আত্মপরিচয় পাওয়া যায় ‘স্নাপিত স্বনিত আমি’ কবিতায়। এ-কবিতায় সাবলীল গতিময়তায় শব্দের ইজেলে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। কবি প্রগতির নদী হয়ে নিরন্তর ছুটে চলেন। মহাশূন্যতায় গ্যালাক্সির স্তব্ধতা ছিঁড়ে দ্রোহের শিখায় স্ফুরিত হন। স্নায়ুযুদ্ধহীন কোমল আগুনের ভস্মস্তূপ থেকে ফিরে আসেন প্রজন্মের সবল পেশিতে। কবি নিজের পরিচয় দিচ্ছেন—

‘আমি আসি অনাগত আমি
নারী ও পুরুষের যুথবদ্ধ তৃপ্তির চিৎকার
মাটি ও ফসলের পরিচিত গন্ধ
শ্যাওলা কি ফণিমনসার ঝোপ, পশুর হিংস্রতা
নাব্য নদীর স্রোত, পলিমাটি, বিস্তারিত সবুজ ছুঁয়ে
আমি আসি সবল পেশীর শৌর্যে, মানুষের অবিরাম সংগ্রামে।’ 
(স্নাপিত স্বনিত আমি : এক কণা সাহসী আগুন)

নারী-পুরুষ, মাটি-ফসল, শ্যাওলা-ফণিমনসা, পশু-হিংস্রতা, নাব্য-নদী, পলিমাটি, সবুজ, সবল পেশীর শৌর্য, মানুষ-সংগ্রাম জোটবদ্ধ শব্দগুলো নিয়ে একটু ভাবলেই কবির মানসপট পাঠকের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একজন কবির ধারাবাহিক কাব্যচর্চায় আলোচ্যবিষয়গুলো ঘুরে-ফিরে কবিতায় প্রাণ-চঞ্চল হয়ে ওঠে। এক কণা সাহসী আগুন গ্রন্থটি কবির কাব্যিক জীবনের প্রাথমিক গ্রন্থকয়ের একটি। ‘স্নাপিত স্বনিত আমি’ কবিতাটি এ-গ্রন্থের প্রথম কবিতা। এখানে এসে কবি তাঁর কবিতার গন্তব্য খুঁজে পেয়েছেন। প্রাকৃতিক জীবনে বেড়ে ওঠা কবি যান্ত্রিক-জীবন ছুঁয়ে কবি এখন আন্তর্জাতিক নগরের নাগরিক। গ্রামের অভিজ্ঞতা, দেশজ-নাগরিক যাপন ও আন্তর্জাতিক শহরে বিচরণ করে কবির কবিতা নানামাত্রিক ভূ-ভাবনায় শব্দায়ন হবে এটাই স্বাভাবিক।
কবি তমিজ উদ্দীন লোদী গ্রামে বড় হয়েছেন। গ্রামকে দেখেছেন নিবিড়চোখে। শৈশবের লবণাক্ত আম-কাঁঠাল-লিচুর স্বাদে-গন্ধে কবি রসালো করেছেন জীবনকে। ছেঁকে দেখেছেন গ্রামীণ হৈ-হুল্লোড়। সেই গ্রামের প্রিয়জনকে কবি ‘তুমি আছ’ কবিতায় সেই তোমার ভেতর দিয়ে গ্রামকে উচ্চমার্গীয় চিন্তায় রেখে এ-কবিতাটি লেখেন। গ্রামের সেই প্রিয়জনকে জমির কাদা মেখে, হাঁটু অব্দি ধুলো নিয়ে চলে আসার আহবান জানিয়েছেন। তার শরীরে—

‘চকচকে আকাঙ্ক্ষার ভেতর নড়ে উঠে নুন
ভাতের উষ্ণ ভাঁপ, ভাজা চিংড়ির স্বাদ
হরেক রকম শাক ও সালুনের গন্ধ মাখা
তুমি চাষী, তুমিই সম্রাট।’ 
(তুমি আছ : এক কণা সাহসী আগুন)‘

‘আন্তঃনগর ট্রেন ও চিত্রকল্প’—কবিতায় গ্রামের চলমান দৃশ্য অবলোকন করেছেন কবি প্রেমসিক্ত চোখে। সরষে ক্ষেত, হলুদ ফুলের ঢেউ, কুয়াশার পালক ওড়া শৌখিন-সৌন্দর্য, ভেসে যাওয়া সাদা বকের সারি, পৌষের শীতে সন্ধ্যার আবিরতা কবি ট্রেনযাত্রী হয়ে গ্রামের দৃশ্য অবলোকন করে মুগ্ধ হয়েছেন। সেখানে এক নারী ট্রেনযাত্রী। এক নারীচরিত্রের মাঝে গ্রামকে অবগাহন করেন। নারীর দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হন কবি। কবি বলেন— 

‘দূরে রোয়াকে দাঁড়ানো এক রোরুদ্যমান নারী
রোগাটে আলোয় তার বাম চোখ ও গণ্ডের কিয়দংশ 
কী অদ্ভুত ভঙ্গিমায় যেন জলছবি মাতিসের
আর কী স্বচ্ছ
শতধা নদীর শাখা ছুটে যায়
টলটলে নীল সমুদ্রের জলে।’ 
(আন্তঃনগর ট্রেন ও চিত্রকল্প : এক কণা সাহসী আগুন)

কবির এ-দেখা কেবল একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। কবি এ-দৃশ্যের অভ্যন্তরে পুরো বাংলাদেশকে কবিতায় তুলে এনেছেন। দেশের প্রতি কবির মানসচিত্র ব্যাপক দৃষ্টি হয়ে যেন পুরোদেশকেই দেখেছেন এক লহমায়। এ-কবিতার শেষ পংক্তিতে কবি বলেন—

‘পরিচিত ব—দ্বীপই কী অদ্ভুত তাজা আর
    ঘ্রাণময় হয়ে ওঠে।’

‘দ্রুতগামী ট্রেনের ভেতর তুমি’ কবিতায় একই ভাবনা ভিন্ন দ্যোতনা লক্ষ্য করা যায়। কবির দৃষ্টি এখানেও এক যৌবন-প্রখর তরুণীর চঞ্চলতায় নিবদ্ধ হয়েছে। এক মানবিক হৃদয় এখানে কেঁপে ওঠে। তার চোখের ভেতর কবির দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। তার হৃদয়ে খেলারত অবিকল ভাবনা কবি ভাবতে পারেন। কবি সেই তার অবয়ব এঁকেছেন এভাবে— 

‘অস্পৃষ্ট যৌবন প্রথম স্পর্শের শিহরণে
যেভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে, সে ভাবেই 
আনত তোমার মুখ
কী দীপ্র ভঙ্গিতে
আলোর ভেতর কাঁপে
যেন অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ দোলায় বাহারী ফিন।’ 
(দ্রুতগামী ট্রেনের ভেতর তুমি : এক কণা সাহসী আগুন)

কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর মানসসত্তা বিকশিত হয়েছে ‘এক কণা সাহসী আগুন’ কবিতায়। এ-কবিতা একটি জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। একটি বাঁক বদলের কবিতা। কবির মানস-সূর্য এখানে ক্ষীণ-উদিত হয়েছে। আশির দশকের কবিদের ভিন্ন একটি কাব্যধারার আভাস এখানে পাওয়া যায়। রাতের আঁধার ঢেকে গেছে স্বপ্নচোখে। সর্বত্রই জটাজালে আচ্ছন্ন আকাশ। নিবিড় অন্ধকারে আলোস্পর্শের আরাধনা নিয়ে কবি এগিয়ে এলেন কবিতার সঙীনতলে। সলতে আলো জ্বালিয়ে উসকে দিতে চান বেড়াজালের চারদিকে। এই আলো গ্লানিহীন অভিমানহীন। তারুণ্যের উচ্ছলতায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন কবি। সুন্দরের রসদ-ছন্দে পরস্পরের মাঝে একটা শৃঙ্খলার আলো জ্বালিয়ে দিতে কবি উদগ্রীব। মানুষের লোভ-হিংসা জ্বালিয়ে দিতে চান কবি। যেমন—

‘তুমি ক্ষিপ্র হাতে বেছে নাও যা কিছু সুন্দর 
আনো সমগ্রতার ছন্দ, পারস্পর্যের শৃঙ্খলা 
প্রস্ফুটিত আলোর খড়কুটো।
তুমি দ্রুত চলে আসো উজ্জ্বল আলোর ভেতর
মানুষের লোভ এবং হিংসার প্রপাত পেরিয়ে
আজন্ম সহচর তুমি হো হো করে হাসো।’ 
(এক কণা সাহসী আগুন: এক কণা সাহসী আগুন) 

‘তুমি দ্রুত চলে আসো উজ্জ্বল আলোর ভেতর’ অথবা ‘নতুন কোনো জেল্লায় আভাসিত হোক এ সময়’ চরণদুটিতে কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর কবিমানস ধরা দিয়েছে। ‘নতুন কোনো জেল্লায়’ ‘উজ্জ্বল আলো’র ভেতর চলে আসার আহ্বান কবির কবিতাযাত্রার একটি অভীষ্ট লক্ষ্য পাওয়া যায়। 
কবি কবিতা লেখেন কোন নেশায়? কবিতা লিখে কী হয়? সারা পৃথিবীর কবিরা কি না বোঝেই কবিতা লিখেন? তাঁরা কি পাগলশ্রেণির কেউ? নানাপ্রকার অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, ক্লান্তি-ক্লেশ-অভিসম্পাত, হিংসা-বিদ্বেষ-রিপু, নারী-যৌনতা, সংসার-সন্তান এসবের কি উর্ধ্বে ওঠে কবি কবিতা লেখেন? পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ-সংস্কৃতি, দেশ-দেশান্তর এসবকে কবি পাত্তা দেন নাকি দেন না? এ প্রশ্নগুলো কবির কাছে নেই। কবি সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এক অমীমাংসিত উত্তর। কবি আর কবিতার কোনো বাজারমূল্য নেই। মূল্যে কখনো কবিতাকে মূল্যায়ন করা যায় না। কবি এক অলৌকিক মেধাস্বত্ব। কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর ‘কবিতায় কি কি হয়’ কবিতায় কবি চমৎকার জবাব দিয়েছেন। কবির চাচা বেকারত্ব দূর করার জন্য কবিকে আহ্বান করেন— 

‘কবিতা লিখে কত টাকা পাও বাবা বলো? তার চেয়ে
চলে এসো আমার খামারে। এখানে ডিম হয়, মাংস হয়। প্রোটিনের
খুব ছড়াছড়ি। গাভীও আছে বেশ কটি। দুধ সেও পাবা খুব।
খুব একটা কিছু করতে হবে না বাপজান। খানিকটা পরিচর্যা,
মাঝে মাঝে কিছু দেখভাল—এ আর এমন কি!’ 
(কবিতায় কি কি হয়)
 
কবির কথিত চাচা জীবনের নিরাপত্তা দিতে চিন্তিত। কবিকে খামারে কাজ দিতে চাইলেন। জীবনের চাহিদা পূরণ করতে চাইলেন। কবিকে বোঝানোর চেষ্টা করতে করলেন এভাবে—

‘কবিতায় কি কি হয়, খুব একটা জানি না বাপজান, তবে এটা জানি
বাড়ি-গাড়ি দূরে থাক পেটে ভাতও জুটে না শেষতক। বিনয় নামের এক কবি
না খেয়ে না খেয়ে মরে ভূত হয়ে গেছে এই আলমডাঙ্গায়। তুমিও কি
এই পথে যাবা! তুমি দেখো নাই কেমন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে এইসব হাভাতে কবির দল!’  
(কবিতায় কি কি হয়)

কবি চাচার কথায় খুব বড় বেশি বলেননি। কবি সামাজিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে সমাজের চোখে যারা খুব সুখী, যাদের জীবন খুব স্বাচ্ছন্দময়, বিলাস-বৈভবে যাদের জীবন আলিশান-যাপনে পরিব্যাপ্ত, যারা খায় আর খায় তাদেরকে সামনে এনে কবির যথোচিত জবাব—

‘কিন্তু চাচা যারা খুব খাচ্ছে দাচ্ছে, খেতে খেতে কেবল খেয়েই যাচ্ছে
তারাও কি খুব ভালো আছে? খাই খাই ইচ্ছেটা তো মরছে না কিছুতেই।
ওরা তো খেয়ে ফেলছে সব, ব্যাংক নদী মাটি...
আরে বেটা কি কথায় কি কথা বলিস যে তুই, আমি কি ওসব বলছি তোকে?
আমি দেখি চাচা রেগেমেগে সম্বোধনই পাল্টে ফেলেছে।’  
(কবিতায় কি কি হয়)

কবিরা এরকম সত্যকথা বলেন। মুখের ওপর ছুঁড়ে দেন সত্যচাবুক। চাচার সম্বন্ধে কবির কোনও কিছু যায় আসে না। মুখের ওপর ছুঁড়ে দিতে পারেন সত্যভাষণ। তিক্তসত্য কথা বলার প্রয়োজন। সবাই সেই সত্য বলতে পারেন না। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই একজন কবির আবির্ভাব ঘটে। এখানেই কবির সার্থকতা। এখানেই লুটিয়ে পড়ে সকল রাজমুকুট। কবির কাছেই সেই সত্যাস্ত্র আছে বলেই কবি অনেক মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদকে কোনো কোনো সমাজ গ্রহণ করে আবার কোনো কোনো সমাজ-রাষ্ট্র অভিঘাত দেয়। তখন কবিকে চরম মূল্য দিতে হয়। তবু পৃথিবীর কবিতা চির ভাস্বর-চিরঞ্জীব-সত্য। কবি সামাজিক সত্য, রাষ্ট্রীয় সত্য, ঐতিহাসিক সত্য, ভৌগোলিক সত্য, সত্য-সুন্দরের কথা বলাই কবির কাজ। তাই কবির কবিতা চাচার খামারে ডিম-মাংস খেতে যায়নি। কবি কবিতাকে নিয়ে গেছেন সুনীল আকাশের নীলিমায়, নদীর ঢেউমাতানো কলগীতে...

‘আমি বলি, চাচা, কবিতা আর যা-ই দিক তস্কর করে না।
আমি আকাশকে আকাশ আর নদীকে নদীই দেখতে চাই চিরকাল
খামার দোষের নয় ঠিক—তবে এটি লোভের দরজা
এ বড় অনন্ত চাচা, একবার পেয়ে গেলে কিছুতে ছাড়ে না।’  
(কবিতায় কি কি হয়)

কবি কখনো লোভের খাতায় হালখাতা উৎসব করে না। লোভের দরজায় খিল এঁটে দিয়ে কবি হয়ে যান একান্ত নির্লোভ-নির্মোহ মানুষ। এই মানুষের জন্যই পৃথিবী আজ অপেক্ষা করছে। মানুষের কল্যাণে কবিতা হয়ে উঠবে কৃষিখামারের সবুজ আচ্ছাদন। কবি তমিজ উদ্দীন লোদী সেই খামারেই শব্দ বুনে যাচ্ছেন। শীলজমিনে স্বপ্ন-বাস্তবতার আঁখখেত নির্মাণ করে সেখান থেকেই রস সংগ্রহ করে সবার গলা ভিজিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাভাষার আশৈশব আয়োজনে বাংলাভাষী মানুষের মনে শেকল ভাঙার প্রাণজ-সাহসে মুগ্ধ করছেন কবি। হৃদয়জ-সুখময়তা, ধ্যান-গভীর মগ্নতা নিয়ে কবি তমিজ উদ্দীন লোদী লেকল ছিঁড়ে তুলে আনছেন রুপালি ঝিনুক। ঊষার আলোয় উদ্ভাসিত হোক কবির উজ্জ্বল স্বপ্ন।
 


মামুন সুলতান কবি ও প্রাবন্ধিক। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : জলভাড়া স্বপ্নসিঁড়ি, মেঘরাখালের বাঁশি। প্রবন্ধ গ্রন্থ : বাংলা কবিতার ছন্দকলা, গ্রন্থের গহীন গল্প। তিনি কর্মসূত্রে সিলেটে বসবাস করেন।

menu
menu