উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ : লিরিক্যাল ব্যালাডস্ রচনার পটভূমি


ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক আন্দোলনের সূত্রপাতের সঠিক সময় নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব থাকলেও ১৭৯৮ সালে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিরিক্যাল ব্যালাড্স্ (Lyrical Ballads = ভাবগাথা) কাব্যগ্রন্থের প্রথম আত্মপ্রকাশের লগ্ন থেকে যে এটির অবয়বের পূর্ণতা ও  গতিপ্রাপ্তি সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর লিরিক্যাল ব্যালাড্স্-এর মাধ্যমে যে এক নতুন সাহিত্যযুগের প্রবর্তন করেছিলেন, কীভাবে সেটার উদ্ভব হলো তা আমাদের একটু খুঁজে দেখা প্রয়োজন। 

এই ভাবগাথা রচনার পিছনে যে সকল ব্যক্তি, বিষয় ও ঘটনাবলী প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ পূর্বসুরী কবিদের রচনা থেকে প্রাপ্ত সাহিত্যিক প্রভাব, সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী এবং কবির ঘনিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
রোমান্টিক ভাবধারার সাহিত্যিক সূত্র খুঁজতে গেলে অবশ্য আমাদেরকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ সময় থেকে আরও বেশ কিছুটা পেছনে চলে যেতে হবে। রোমান্টিক আবেগের অস্তিত্ব আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকের কবিতাগুলোতে প্রথম অনুভব করা যায়।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ কেবল রোমান্টিকতাকে একটা নির্র্দিষ্ট গণ্ডি টেনে অতীতের এবং তৎকালীন অন্যান্য কাব্যিক চিন্তাধারা থেকে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা এই ভাবধারার স্রষ্টা বা প্রবর্তক নন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ এবং এঁদের পরবর্তী সময়ের কবিরা, অর্থাৎ স্যার ওয়ল্টার স্কট, লর্ড বায়রন, পিস্ বিশে শেলি বা জন কিট্স্ তাঁদের পূর্ববর্তী যে সকল কবিদের রচনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জেমস্ টমসন্ (১৭০০-১৭৪৮), টমাস্ গ্রে (১৭১৬-১৭৭১) এবং উইলিয়ম কলিন্স্ (১৭২১-১৭৫৯) এই নব আন্দোলনের অগ্রদূত বলে মনে করা হয়। কারণ এঁদের কিছু কিছু কবিতাতে প্রথম রোমান্টিক আবেগের স্ফুরণ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

যদিও টমসন, গ্রে ও কলিন্স সেই সময়ের কঠোর ক্ল্যাসিকাল ভাবধারার সামিয়ানার তলায় সমবেত ছিলেন এবং সেই ভাবধারার প্রতি প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেননি, তা সত্ত্বেও তাঁদের রচনায় তৎকালীন কাব্যধারা থেকে একটা প্রচ্ছন্ন পৃথক গতি ও সুর লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এঁদের কাব্যের ধারা, প্রকৃতি ও ভাবের আবিষ্টতার ভেতর এক নতুন ফল্গুধারা পাঠকের মনে অভূতপূর্ব স্বাদ ও সুরের মূর্চ্ছনা সৃষ্টি করেছিল। বীর-রসাত্মক যুগ্মপংক্তির (Heroic Couplet) স্থান দখল করল স্পেনসারের অনুকরণে লেখা পংক্তিমালা আর মিল্টনের অমিত্রাক্ষর ছন্দ। প্রকৃতি-প্রেম, কাব্যের গীতিময়তা, শোকানুভূতি (Elegiac note) এবং নতুনভাবে মধ্যযুগীয় আবেগময়তা জেমস্ টমসন, গ্রে আর কলিন্সের কাব্যের মূলসুর হয়ে উঠল।  

১৭২৬ সালে লেখা টমসন২-এর Seasons কবিতায় এই নতুন সুরের প্রথম আবির্ভাব। কবিতাটিতে অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে কবিতার গঠনপ্রকৃতিতে কিছুটা নৈপুণ্যের অভাব লক্ষ্য করা গেলেও পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা, আবেগের নবীনতা ও প্রকৃতির আনন্দঘন সুর কবিতাটিকে অত্যন্ত আবেগময় করে তুলেছে। স্পেনসারীয় ছন্দে ১৭৪৮ সালে লেখা The Castle of Indolence কবিতাটির ছন্দময়তা অনেকাংশে অনুকরণ মনে হলেও এর অপূর্ব ইঙ্গিতময়তা ও লালিত্যময় ছন্দ পাঠককে আবিষ্ট করে তোলে। 

উইলিয়াম কলিন্স২-এর Odes টমসনের কবিতার চেয়ে আরও গভীর আবেগময়তায় ভরা কাব্যগ্রন্থ। কবিতাগুলোর মধ্যে Ode to Evening এক অদ্ভুত মিষ্টি কমনীয়তা, ম্লান বেদনা অথচ ঐন্দ্রজালিক মোহময় শব্দভাণ্ডারে সমৃদ্ধ।  
টমাস গ্রে৩-র Elegy আবেগময়তা ও অকৃত্রিম বেদনার অনুরণনে ভরা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরেজি কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিরা হলেন বিশপ্ পার্সি, চ্যাটারটন এবং ম্যাকফারসন।

১৭৬৫ সালে প্রকাশিত বিশপ্ পার্সি৪র Relique কবিতাটি রোমান্টিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। গাথা কাব্যের সবচেয়ে প্রাচীন ও সুন্দরতম নমুনা হিসেবে খ্যাত এই কবিতাটি পরবর্তীকালে কোলরিজ ও কিট্স্কেকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল।

চ্যাটারটনে৫র Rowly Poems কবিতাগুলো যদিও বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবিতা হিসেবে অখ্যায়িত করা যায় না, তা সত্ত্বেও কবিতাগুলোতে মধ্যযুগীয় বীর বন্দনার সঙ্গে রোমান্টিক অনুভূতিসম্পন্ন আবেগময় ছন্দের সংমিশ্রণ পরবর্তী রোমান্টিক কবিদের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

ম্যাকফারসনে৬র Ossian একটি ছন্দময় গদ্য রচনা। পৌরাণিক বীর Fingal-এর রোমান্টিক দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা এমন একটি সুললিত কাব্যময় ভাষায় রচিত হয়েছে যে গদ্য রচনা হলেও এটি অত্যন্ত প্রশংসিত রোমান্টিক সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

তৃতীয় পর্যায়ের কবিরা হলেন অলিভার গোল্ডস্মিথ, উইলিয়াম কুপার ও রবার্ট ক্র্যাব। 
অলিভার গোল্ডস্মিথে৭র Deserted Village কবিতাটি বীর রসাত্মক যুগ্মপংক্তিতে লেখা হলেও কমনীয় অথচ করুণ আবেগময় মানবীয় ভাবাবিষ্টতায় ভরপুর। অমিত্রাক্ষর ছন্দে সরল ও পরিচিত গ্রামীণ পরিবেশ নিয়ে লেখা এটি একটি মধুর রোমান্টিক আবেগমণ্ডিত কবিতা।

প্রকৃতি-প্রেমিক উইলিয়াম কুপার৮কে রোমান্টিক আন্দোলনের সক্রিয় অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। যদিও তাঁর কাব্যে অনেকে যথেষ্ট বলিষ্ঠতার অভাব লক্ষ্য করেছেন।

রবার্ট ক্র্যাব৯ এই সকল অর্ন্তবর্তীকালীন কবিদের মধ্যে কনিষ্ঠতম হলেও তাঁকে আঠারো শতকের কবি হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাঁর The Village কবিতাটিতে গ্রামীণ সরল জীবনের কথা বলা হয়েছে। কবিতাটিতে কবি ক্র্যাবের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও সহৃদয় অর্ন্তদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। 
শেষ পর্যায়ের কবিরা হলেন রবার্ট বার্নস্ এবং উইলিয়াম ব্লেক। 

রবার্ট বার্নস্১০ও ব্লেক১১ উভয়েই আঠারো শতকের শেষের দিকের কবি। ফলে প্রচলিত বিশুদ্ধ ক্ল্যাসিকাল ভাবধারা তাঁদের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি বললেই চলে। অন্যদিকে তাঁরা রোমান্টিক ধ্যানধারণার প্রতি অনেক বেশি বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ তাঁদের পূর্বসুরী কবিদের কাছ থেকে যে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেবল সাহিত্যিক প্রভাবই নয়, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রবর্তিত রোমান্টিক আবেগের পিছনে তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরা ও পটপরিবর্তন বেশ গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব১২-এর স্ফুরণ যুবক ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের মূল সুর—স্বাধীনতা, একতা ও ভ্রাতৃত্বের ভেতর থেকেও রোমান্টিকতার স্ফুরণ তৎকালীন বহু দেশে প্রভাব বিস্তার করেছিল। যদিও ফরাসি বিপ্লব ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ কাছে কোন নতুন  বার্তা বয়ে আনেনি, কারণ তার মন অনেক আগে থেকেই বিপ্লবী মূল চেতনার সুরে অনুরণিত হচ্ছিল। তাঁর এই অবদমিত আবেগের সঙ্গে বিপ্লবের সংবাদ মিশে তাঁর মনোজগতে এক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, যা তাঁর সমস্ত  চিন্তাচেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

এই সময়েই ওয়ার্ডসওয়ার্থ একাধিকবার ফ্রান্স ভ্রমণে যান এবং সেই সময়ে বিপ্লবের অন্যতম নেতা মিশেল ব্যুপের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে মিশেল ব্যুপের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ লোকায়ত সরকার ও মুক্ত সমাজের বিভিন্ন সম্ভাবনা ও সমস্যা সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করেন এবং অনেক অজানা তথ্য জানতে পারেন। এই দীর্ঘ আলোচনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ ধীরে ধীরে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের বিপথগামিতা সম্পর্কে জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হন। তখনই অসহায় আর অত্যাচারিত মানবাত্মার প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসায় তাঁর মন আরও বেশি আপ্লুত হয়ে ওঠে।

ফরাসি বিপ্লব পথভ্রষ্ট হলেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবি মনে কিন্তু বিপ্লবের স্বাধীনতা, একতা ও ভ্রাতৃত্বের মন্ত্র আরও দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত হলো। যদিও এই সময়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, তাতে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কবি মন অনেকটা আশাহত হয়ে পড়ে। তাঁর এই বিশ্বপ্রেমী মনোভাবের উপর দ্বিতীয় আঘাত এলো যখন তিনি জানতে পারলেন ফরাসি বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা, একতা আর ভ্রাতৃত্বের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে রাজ্য বিস্তারের নেশায় পার্শ্ববর্তী দুর্বল সুইজারল্যান্ড দখলের মাধ্যমে সামরিক সম্প্র্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করেছে।

জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে ঘোষিত ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে ব্যর্থ হলেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনে এই ঘটনা ও আদর্শ একটি পরম মুক্তির সনদ হিসেবে চিরজাগরিত হয়ে থাকল। এই ঘটনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা হতাশ হলেও তিনি নিজে তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে এই আদর্শকে লালন করতে থাকলেন। এই আবেগই পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। 

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ জীবনে যে সকল ব্যক্তিত্ব প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং যাঁদের দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহার তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল, তাঁদের মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এক বৎসরের ছোট সহোদরা বোন ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ১৩ সারা জীবন কবির সঙ্গে অতিবাহিত করেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রে ভাই ও বোন একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হতেন, একই ছন্দে ও একই সুরে তাঁদের মন একইভাবে নেচে উঠত।

প্রথম জীবনে কৈশোরকালে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর বাধ্যবাধকতা ও অসারতার ফলে এর প্রতি তীব্র আগ্রহহীনতা, শিশুকালে বাবা-মায়ের অকাল মৃত্যুতে গড়ে ওঠা নিরাপত্তাহীনতা, যুবা বয়সে পেশা নির্বাচনে অনিশ্চয়তা, অথচ কবি হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করাতে বিলম্ব প্রভৃতি কারণে ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রায় পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত অত্যন্ত অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে কালাতিপাত করেছিলেন। এই অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা তাঁর কাব্য রচনাতেও যথেষ্ঠ ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছিল।

১৭৯৫ সালে আকস্মিকভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জানতে পারলেন তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধু রেসলি কালভার্ট মৃত্যুকালে তাঁকে নয়শো পাউন্ড উপহার হিসেবে দান করে গেছেন। এই অর্থ দিয়েই ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর দীর্ঘকালের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়ন করতে পারলেন। তিনি ও ডরোথি ইংল্যান্ডের ডরসেট অঞ্চলের নিরিবিলি পরিবেশে ছোট একটা জমিদারি কিনতে সক্ষম হলেন। এই অঞ্চলই ইংরেজি সাহিত্যের ও রোমান্টিক আন্দোলনের ইতিহাসে লেক ডিস্টিক্ট নামে খ্যাতি লাভ করেছিল।
চারধারের ছোটছোট পাহাড়, ঘনশ্যাম মায়াময় বনাঞ্চল ও স্বপ্নময় ছোটছোট হ্রদ ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনে প্রকৃতির এক অসাধারণ সুন্দর স্বপ্নরাজ্যের দ্বার উন্মোচিত করে দিল। এখানে এসেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবি প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ রূপ বিকশিত হতে আরম্ভ করল।

এখানেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ সঙ্গে কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজে১৪র  পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। পরিচিত হওয়ার আগে কোলরিজ ওয়ার্ডসওয়ার্থ কয়েকটি রচনা পড়েছিলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে একজন অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন এ বিষয়ে কোলরিজ নিঃসন্দেহ ছিলেন।
এদের দুজনের বন্ধুত্ব বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর ও পবিত্রতম বন্ধুত্ব হিসেবে মনে করা হয়। কোলরিজ ওয়ার্ডসওয়ার্থকে ‘মহান ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে ‘অলৌকিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ’ বলে সম্বোধন করতেন। কোলরিজ বলতেন, ‘সকল ব্যবহারে, সকল কর্মে, উৎকর্ষতায় আমি তাঁর থেকে নগণ্য’। অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরিজকে ‘আমার জানা মতে সারা জীবনে কোলরিজই সবচেয়ে সুন্দরতম মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

দুজনের কবি মনের গতিধারার দু’টি পৃথক বহমানতা প্রথম থেকেই সুষ্পষ্ট ছিল। কোলরিজের রজতশুভ্র, অত্যুৎসাহী, সমুজ্জ্বল, অথচ অস্থির প্রকৃতি; অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ পশ্চাদপসারিতা, অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন, অথচ বিচক্ষণ প্রকৃতি অদ্ভুত নিবিড় সখ্যতায় নতুন মতাদর্শ সৃষ্টিতে একই গতিধারায় বইতে আরম্ভ করে।

কোলরিজ সমস্ত অস্তিত্বকে, সমগ্র প্রকৃতিকে দেবদূতের মতো নির্লিপ্ততায় দূর থেকে অবলোকন করতে পছন্দ করতেন, অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ অস্তিত্ব ও প্রকৃতির প্রতিটি সূক্ষ্ম পরিবর্তনই অত্যন্ত নিকট থেকে গভীর ও শান্তভাবে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করে সেটি নিয়ে কল্পনার স্বপ্নসৌধ রচনা করতে চাইতেন। এঁদের দুজনের আপাত ভিন্ন, অথচ একই গতিধারাকে বোধকরি একমাত্র ডরোথিই গভীরভাবে অনুভব করতে পারতেন। আর তাই এই দুই কবি প্রতিভাকে উত্তেজিত করতে, উদ্বেলিত করতে তিনি সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।

১৭৯৭ সালে লিরিক্যাল ব্যালাড্স্ রচনার প্রথম প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং পরের বৎসর রচয়িতার নামবিহীন অবস্থায় সেটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই কাব্যগ্রন্থটিকে ‘পরীক্ষামূলক রচনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘এই পরীক্ষামূলক রচনায় সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের মুখের ভাষার চয়িত অংশকে কাব্যিক তৃপ্তি আনার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে’। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যে সকল পাঠক সমসাময়িক কবিতার বাগাড়ম্বরপূর্ণ বাক্যবিন্যাসে অভ্যস্ত, তাঁরা হয়তো এ কবিতা পছন্দ করবেন না’। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, ‘তবু যদি পাঠক এ সকল কবিতা কষ্ট করে পড়েন, তবে হয়তো তাঁদের ভালো লাগতেও পারে’।

লিরিক্যাল ব্যালাড্স্ ইংরেজি সাহিত্যের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে মনে করা হলেও প্রচারের দিক দিয়ে তৎকালীন পাঠক-সমাজের মনে তেমন কোন উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারেনি, যদিও গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের সকল কপি দুই বৎসরের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়।
কবিতাগ্রন্থটির প্রথম সংস্করণে কোন ভূমিকা বা মুখবন্ধ সংযোজিত ছিল না, তবে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাগুলো সম্পর্কে কিছু বক্তব্য “বিজ্ঞাপন” শিরোনামে গ্রন্থটিতে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সংস্করণেই প্রথম এই বহুল আলোচিত মুখবন্ধটি সংযোজন করা হয়।

লিরিক্যাল ব্যালাড্স্-এর মুখবন্ধ কেবল ইংরেজি সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের দর্শন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কেবল সাহিত্য বা কাব্য সাহিত্যের পর্যালোচনা হিসেবেই নয়, লিরিক্যাল ব্যালাড্স্-এর মুখবন্ধ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনা হিসেবে স্বীকৃত, অবশ্য যদি এটিকে গদ্য রচনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভাষায়, ‘কাব্য ও গদ্য ভাষার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।’

গ্রন্থপঞ্জি 
১. জেমস টমসন (সেপ্টেম্বর ১১, ১৭০০ - আগস্ট ২৭, ১৭৪৮) স্কটিশ কবি ও নাট্যকার।
২. উইলিয়াম কলিন্স (ডিসেম্বর ২৫, ১৭২১ - জুন ১২, ১৭৫৯) অষ্টাদশ শতকের মধ্য দশকের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তার লিরিক্যাল ওডস্ কবিতাগুলোতে আলেক্সান্ডার পোপের সময়কার অগাস্টান কবিতার ধরন থেকে বেরিয়ে এসে রোমান্টিক ভাবধারার পরিস্ফুটন লক্ষ্য করা যায়।
৩. টমাস গ্রে (১৭১৬-১৭৭১) কবি ও গবেষক। তার ঘনিষ্ট বন্ধু কবি রিচার্ড ওয়েস্ট (১৭১৭-১৭৪২)-এর মৃত্যুর পর মর্মাহত হয়ে কাব্য রচনা শুরু করেন। মধ্য আঠারো শতেকের অত্যন্ত বিশিষ্ট কবি হিসেবে পরিচিত। তাকে পোয়েট লরেট হিসেবে রাজা মনোনিত করলে তা’ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৭৫০ সালে লিখিত Elegy Written in a Country Churchyard কাব্যটি ইংরেজি সাহিত্যের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত।
৪. টমাস পার্সি (এপ্রিল ১৩, ১৭২৯ - সেপ্টেম্বর ৩০, ১৮১১) ড্রমোরের বিশপ। বিশপ পার্সি নামে সমধিক পরিচিত। গার্ডিয়ান ও স্পেকটেটর প্রভৃতি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৭৬৫ সালে তার লেখা Reliques of Ancient English Poetry কাব্যগ্রন্থ তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
৫. টমাস চ্যাটারটন (নভেম্বর ২০, ১৭৫২ - আগস্ট ২৪, ১৭৭০) মাত্র ১৭ বছর বয়সে ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্য করেন। তাকে ‘আইকন অব আনএকনলেজড্ জিনিয়াস ফর দি রোমান্টিকস্’ আখ্যা দেয়া হয়। 
৬. জেমস ম্যাকফারসন (অক্টোবর ২৭, ১৭৩৬ - ফেব্রুয়ারি ১৭৯৬) স্কটিশ কবি। 
৭. অলিভার গোল্ডস্মিথ (নভেম্বর ১০, ১৭৩১ [মতান্তরে ১৭২৮] - এপ্রিল ৪, ১৭৭৪) ইংরেজি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। ভিকার অব ওয়েকফিল্ড উপন্যাস ও দি ডেজার্টেড ভিলেজ পল্লীকাব্যের জন্য বিখ্যাত। 
৮. উইলিয়াম কুপার (নভেম্বর ২৬, ১৭৩১ - এপ্রিল ২৫, ১৮০০) ইংরেজি সাহিত্যে একজন বিশিষ্ট কবি। তার সময়ে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। তার কবিতায় ইংল্যান্ডের দৈনন্দিন জীবন ও গ্রামীণ চিত্র ফুটে উঠেছে।
৯. জর্জ ক্র্যাব (ডিসেম্বর ২৪, ১৭৫৪ - ফেব্রুয়ারি ৩, ১৮৩২) আবেগশূন্যভাবে মানুষ, ঘটনা এবং দৃশ্যমান প্রকৃতি বর্ণনার সূক্ষ্মতা তাকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। 
১০. রবার্ট বার্নস (জানু. ২৫, ১৭৫৯ - আগস্ট ২৭ ১৭৯৬) স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এই কবি রাব্বি বার্নস বা প্লাউম্যান পোয়েট নামে সমাধিক পরিচিত। তাকে স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি হিসেবে মনে করা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা স্কটিশ ভাষায় লেখা হলেও ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতার মধ্যেও স্কটিশ ভাবধারা লক্ষ্যণীয়।
১১. উইলিয়াম ব্লেক (নভেম্বর ২৮, ১৭৫৭ - আগস্ট ১২, ১৮২৭)। কবি, চিত্রকর ও মুদ্রাকর। জীবদ্দশায় খুব বেশি পরিচিতি লাভ করেননি। আধুনিককালে তার কাব্য ও চিত্রকলার জন্য সমধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
১২. ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সসহ সমগ্র ইউরোপের বিশাল রাজনৈতিক ও সামজিক পট পরিবর্তন সূচিত হয় এই ফরাসি বিপ্লবর মাধ্যমে। রাজতন্ত্র ও সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক যাজক শ্রেণির অত্যাচারের রক্ষাকবচ হিসেবে এর আবির্ভাব হয়, যার মূল সূত্রগুলো ছিল স্বাধীনতা, একতা, ভ্রাতৃত্ব, জাতীয়তাবাদ, নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারবোধ।
১৩. ডরোথি মায়ে এ্যান ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ (ডিসেম্বর ২৫, ১৭৭১ - জানুয়ারি ২৫, ১৮৫৫) কবি ও দিনলিপিকার হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। রোমান্টিক করি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ভগনী। তার সারা জীবন জুড়েই তিনি ভাইয়ের সঙ্গে জীবন যাপন করেছেন। লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ না করলেও তার রচিত পত্রাবলি, দিনলিপি ও ছোটগল্প যথেষ্ট জনপ্রিয়।
১৪. স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৪৩) ইংরেজ কবি, সমালোচক ও দার্শনিক। ওয়ার্ডসওয়ার্থ সঙ্গে রোমান্টিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তিনি The Rime of the Ancient Mariner এবং Kubla Khan কবিতা দুটির জন্য সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। কোলরিজ তাঁর সাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থ Biographia Literaria-এর জন্যও প্রসিদ্ধি লাভ করেন।


সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। তাঁর অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬৪ টি। তিনি বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থার ইতিহাস, ডাকটিকিট এবং বাংলাদেশের আধুনিক ধাতব ও কাগজি মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে ৩২টি অনন্য গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এই সকল গবেষণা গ্রন্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, চীন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, শারজাহ ও দক্ষিণ কোরিয়া ডাকটিকিট প্রদর্শনী থেকে পুরষ্কার লাভ করেন। এ যাবৎ সিদ্দিক মাহমুদের ১৩২টা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 

menu
menu