মাদক মহামারী ও আফিম যুদ্ধের ইতিকথা

ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী মাদকাসক্তির প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে তা এখন মহামারীর পর্যায়ে। এর ভেতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বিশেষভাবে শোচনীয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নাগরিকদের বেশিরভাগ মৃত্যু এখন মাদকাসক্তির কারণে। যুদ্ধে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ এই পরিসংখ্যান।  

এই সময়ের সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগটি হচ্ছে ফেনটানিল নামক ভয়ঙ্কর মাদকের বিস্তার। দিনে প্রায় আড়াইশো তরুণ-তরুণীর মৃত্যুর কারণ এই ফেনটানিল ওভারডোজ। এই নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস এবং সিনেটের বিক্ষুব্ধ বিতর্কে এখন দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বাইরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হচ্ছে। প্রধান অভিযোগ চীনের বিরুদ্ধে, কারণ ফেনটানিলের কাঁচামাল চীন থেকেই পাচার হয়ে আসে। একজন সিনেটর তো বলেই বসলেন, এ হচ্ছে পশ্চিমের প্রতি চীনের আফিম যুদ্ধের প্রতিশোধ। 

এই পটভূমিতে বর্তমান লেখায় আমরা ফিরে যাব আফিম যুদ্ধের ইতিহাসে, দেখব উপনিবেশবাদী পশ্চিমের বাণিজ্য স্বার্থে কীভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে মাদক পাচারকে বৈধতা দেয়া হয় সেই সময়। একই সঙ্গে আরও খতিয়ে দেখব বর্তমান মার্কিন সমাজে মাদকাসক্তির বিস্তারের পেছনের বাণিজ্যিক অনুষঙ্গগুলো।
   
আফিম যুদ্ধের ইতিকথা  
সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা জয় করার পর গোটা ভারত গ্রাসে ব্যস্ত। একই সময়ে চীন ও ইন্দোনেশিয়াতেও ব্রিটিশ বাণিজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চলছে জোরে সোরে। ওই সময়ে চীন থেকে ইংল্যান্ডে আমদানি করা হতো চা, সিল্ক এবং সিরামিক। বিনিময়ে ইংল্যান্ড থেকে চীনে রপ্তানিযোগ্য তেমন কিছুই ছিল না। ফলত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয় এবং ক্রমবর্ধমান এই বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা শুরু হয়।

ইংল্যান্ডে চা তখন ফুলে ওঠা মধ্যবিত্তের আভিজাত্যের অনুষঙ্গ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্রেজ। চাহিদা মেটাতে প্রচুর চা আমদানি করতে হতো চীন থেকে। চায়ের ওপর আমদানি শুল্ক ছিল ১০০% এর বেশি এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অভ্যন্তরীণ আয়ের বড় অংশ। এই বিপুল পরিমাণ চা আমদানির জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হতো রৌপ্য মুদ্রায়, কারণ চীন অন্য কোনো মুদ্রা গ্রহণ করত না। এদিকে ইংল্যান্ডে রুপার খনি নেই, রৌপ্য আমদানি করতে হতো মেক্সিকো থেকে, সেখানেও সরবরাহের ঝক্কি ছিল। একসময় ব্রিটিশ রাজকোষে রৌপ্য মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিলে মূল্য পরিশোধ ঝুঁকির ভেতরে পড়ে এবং বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে আলোচনাটা আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিকল্প মাধ্যম খুঁজতে যখন সবাই শশব্যস্ত, তখন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস একটা অদ্ভুত সমাধানের প্রস্তাব দিলেন। 

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সে সময় চিকিৎসার জন্য সীমিত আকারে আফিমের চাষ হতো, এর ভেতরে বাংলা ও বিহার ছিল অন্যতম। চীনে আফিম চাষ নিষিদ্ধ তাই চোরাবাজারে এর দাম আকাশচুম্বী। হেস্টিংস সাহেব বাংলা থেকে চীনে আফিম রপ্তানির প্রস্তাব দিলেন। ভারত থেকে সমুদ্রপথে আফিম যাবে চীনা উপকূলে, সেখান থেকে চোরাই পথে মূল ভূখণ্ডে চীনা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে। এবং এই আয় দিয়ে কেনা হবে চা, যা জাহাজ বোঝাই হয়ে যাবে ইংল্যান্ডে।

এই নতুন রপ্তানি দ্রব্যের জন্য চাই পর্যাপ্ত এবং স্থিতিশীল উৎপাদন। ব্রিটিশ রাজ ঘোষণা দিয়ে আফিম উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের একচ্ছত্র অধিকার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। এবং নীল চাষের মতোই বাংলা এবং বিহারের বিপুল কৃষিভূমিতে জোরপূর্বক আফিম চাষে কৃষকদের বাধ্য করে। পাশাপাশি বোম্বেতে গড়ে তুলে বিশাল আফিম প্রক্রিয়াজাত এবং বাণিজ্য কেন্দ্র। 

খোদ বিলেতে আফিম নিষিদ্ধ, চীনেও আফিম নিষিদ্ধ। কিন্তু এই নিষিদ্ধ জিনিসটিই ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে উৎপাদন করে বেআইনিভাবে চালান করা হতো চীনের সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে। এর মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল মুনাফা ব্যবহার করা হতো চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য। খুব সম্ভব এটিই সরাসরি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে মাদক চোরাচালানির প্রথম উদাহরণ।  

হু হু করে বাড়তে থাকে এই চোরাচালান। ১৮০০ সালে প্রেরিত তিনশো মেট্রিক টন ১৮৪০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার পাঁচশো টনে। দেখা গেল, উনিশ শতকের শেষ দিকে চীনের সঙ্গে ব্রিটেনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তি, সেইসঙ্গে আফিম ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্রিটিশ বণিকদের বিপুল মুনাফা। ততদিনে গোটা চীন আসক্ত হয়ে পড়েছে আফিমে, সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমে চলমান মাদকাসক্তির মতোই সংকটে নিপতিত হয় চীন। সম্রাট দাও গোয়াং আফিমের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন, সৈন্য পাঠিয়ে সারা দেশের আফিমের মজুতগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। ওই অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীদের ২০ হাজার চেস্ট আফিম ধ্বংস করা হয়, যার তৎকালীন আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ২ মিলিয়ন পাউন্ড। এর মূল মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানি এবং এই অভিযানে শুধু কোম্পানির বিপুল অর্থের লোকসান হয়নি, বরং চীনের সঙ্গে ব্রিটিশ বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের সরকারি মাধ্যমটিই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বাণিজ্যলিপ্সু উপনিবেশবাদী ব্রিটেনের কাছে এ ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে পরাক্রমশালী ব্রিটিশ রাজ চীনের উপকূলে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে ধ্বংসকৃত আফিমের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে।  

অর্থাৎ নিষিদ্ধ মাদকের বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য চীনা সরকারের কাছে এই ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। চীন এতে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় প্রথম আফিম যুদ্ধ। উন্নত অস্ত্র সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনী শুরুতেই হংকং দ্বীপটি দখল করে নেয় এবং অবশেষে ১৮৪২ সালে নানকিং চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। চীনা ভূখণ্ডে আফিম ব্যবসা নিষিদ্ধ থাকে কিন্তু ব্রিটিশ পক্ষ হংকংয়ের দীর্ঘমেয়াদী লিজ আদায় করে নেয়, যেখান থেকে মূল চীনা ভূখণ্ডে আফিম পাচার আরও সহজ হয়ে যায়। চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলোতে এখন হংকংয়ে নিবন্ধিত হয়ে ব্রিটিশ পতাকা নিয়ে অবাধে ঘোরাফেরা করা শুরু করল, মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের পাচার চালিয়ে যেতে লাগল বল্গাহীন। 

এদিকে চীনের অভ্যন্তরে আফিম আসক্তি বাড়তে থাকে ক্রমাগত। প্রতিকারের আর কোনো উপায় না দেখে চীনা সরকার আবারও শক্ত হাতে মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করতে নামে। চোরাচালান রোধে সমুদ্রে তল্লাশি জোরদার করা হয়। ১৮৫৬ সালে ‘Arrow’ নামের ব্রিটিশ পতাকাবাহী একটা চীনা জাহাজ (যা আগে চোরাচালানীরা ব্যবহার করতো) থামিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। দেখা গেল জাহাজটির কাগজপত্র ঠিক নেই, হংকংয়ে নিবন্ধনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। জাহাজে পাওয়া গেল আগের চোরাচালানির মামলার অভিযুক্ত তিনজন আসামি। ওই তিনজনকে আটক রেখে জাহাজের বাকি নাবিকদের ছেড়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক আইনের কোনো ব্যত্যয় না-ঘটলেও একে আফিম বাণিজ্যের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে নিয়ে বিক্ষুব্ধ ব্রিটিশ সরকার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সঙ্গে যোগ দেয় ফ্রান্স, আমেরিকা ও রাশিয়া। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ নামের এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল চীনে আফিম সেবন ও ব্যবসাকে বৈধ করা এবং ব্রিটিশ সওদাগরদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দেয়া। যুদ্ধে চীনা বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে, পিকিংয়ের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ দখল ও ধ্বংস করা হয়, সম্রাট পালিয়ে যান এবং অবশেষে তার মৃত্যু ঘটে। 

চীনের সঙ্গে এক অপমানকর চুক্তির পর দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী চীনে আফিম সেবন, আমদানি ও বাজারজাতকরণকে বৈধ করা হয়। ১৮৮০ সালে ভারত থেকে ৬৫০০ টন আফিম যায় চীনে, বাজার সয়লাব হয়ে যায় ভারতীয় আফিমে। আফিম রপ্তানির বিপুল আয় দিয়ে চা আর সিল্ক কেনা হতো। অর্থাৎ এই খাতে চীনা কোষাগারে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা জমা পড়ত না। বাধ্য হয়ে চীন নিজ নাগরিকদের জন্য আফিম চাষ বৈধ ঘোষণা করে। যে চীনে প্রায় একশো বছর যাবৎ আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ ছিল তা এখন অবারিত। মাদকাসক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর সমাজতাত্ত্বিক ফল সুদূরপ্রসারী। বলা হয়ে থাকে হাজার বছরের চীনা সংস্কৃতি ও সমাজ-মানস আসক্তির কবলে নিপতিত হয়, যেখানে কনফুসিয়াসের শক্তিশালী দর্শনও ম্লান হয়ে যায়।  

মাদক বিরোধী যুদ্ধের কাহিনি  
War on drugs এই কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ১৯৭১ সালে এক বক্তৃতায়। অর্ধশতাব্দী আগে ঘোষিত সেই যুদ্ধ এখনো চলছে, যার পিছনে ইতোমধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করা হয়েছে। 

যেকোনো সমাজের মতো মার্কিন সমাজেও নানাবিধ আসক্তির উপস্থিতি ছিল, কিন্তু তা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়নি আগে। ষাটের দশকেই এর হঠাৎ বিস্তার দেখা যায়, যার সঙ্গে সরাসরি যোগ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের এবং যুদ্ধ ফেরত যুবকদের হতাশাগ্রস্ত সামাজিক জীবনের।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনারা খোলামেলাভাবেই মাদক দ্রব্য ব্যবহার করত এবং এর প্রভাব নিয়ে তখনই আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে জন মারফি এবং রবার্ট স্টিলি নামের দুইজন কংগ্রেসম্যান এই নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেন, যাতে দেখা যায় ভিয়েতনামে অবস্থানরত প্রায় ১৫% সেনা হেরোইনে আসক্ত, আসক্তিহীন মাদক গ্রহণকারীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এর প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী নিয়ম করে যে, ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফেরার আগে প্রত্যেক সেনা সদস্যদের ড্রাগ টেস্ট করা হবে এবং আসক্তি মুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত এদের দেশে ফিরতে দেয়া হবে না। কিন্তু এতে কাজ হয়নি, দেশে ফেরার পর লক্ষ লক্ষ হতাশাগ্রস্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত সেনাদের মাদকাসক্তির হার বাড়তেই থাকে। 

আসক্তিকে জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে ঘোষণা করা হয় দেশের এক নম্বর শত্রু হিসেবে। তৈরি করা হয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, মন্ত্রীর পদমর্যাদার একজন ‘ড্রাগ জার’-এর অধীনে পরিচালিত হয় এর বিশাল কার্যক্রম, বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট। মাদকবিরোধী আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হয়। দলে দলে মাদকসেবীদের জেলে পাঠানো শুরু হয়। বছরে প্রায় পনের থেকে বিশ লক্ষ লোকের কারাবাস এই মাদক জনিত মামলায়। কিন্তু এতেও ফল হয় না তেমন, মাদক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে আর বিদেশ থেকে মাদক চোরাচালানিও বাড়তে থাকে। বেসামাল মার্কিন সরকার এবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও এই যুদ্ধের বিস্তার ঘটায়। ১৯৮৯ সালে ২৫,০০০ সৈন্য পাঠানো হয় পানামায়, দেশের প্রেসিডেন্ট মেন্যুয়াল নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ধরে আনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। কলাম্বিয়া এবং হন্ডুরাসেও মাদক নিরোধী সেনা ইউনিট পাঠানো হয় বিভিন্ন সময়ে। 

দুর্ভাগ্যবশত মাদকবিরোধী এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন আধিপত্য এবং কমিউনিস্ট বিরোধী তৎপরতার রাজনৈতিক অভিলাষটিও অপ্রচ্ছন্ন ছিল না, তাই পুরো প্রয়াসটিই একসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আসক্তির বিস্তার, ওষুধ বাণিজ্যের ভূমিকা
নব্বইয়ের দশক থেকে চিকিৎসক সমাজ আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যথা-বেদনার প্রকোপ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। চিকিৎসকদের সচেতন করা হয় যে, ব্যথাহীন জীবন যাপন প্রতিটি মানুষের অধিকার, পরামর্শ দেয়া হলো ‘ব্যথা’কে পঞ্চম ভাইটাল সাইন হিসেবে নিয়মিতভাবে নথিবদ্ধ করতে। ভাইটাল সাইন হিসেবে পরিচিত শরীরের বাকি চারটি বাহ্যলক্ষণ—তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস যথাযথভাবে পরিমাপ করা যায়। কিন্তু ব্যথা নিরুপণের কোনো যন্ত্র নেই এবং একে পরিমাপও করা যায় না। তাই নির্ধারিত হলো রোগী নিজেই প্রকাশ করবে ব্যথার পরিমাণ, ১ থেকে ১০ পর্যন্ত স্কেলে তা লিপিবদ্ধ করা হবে। বিষয়টা মানবিক এবং ব্যথা উপসমের সঙ্গত দায়িত্ব থেকেই উৎসারিত। কিন্তু বাস্তবে দ্রুত এর অপব্যবহার শুরু হয়, মূলত নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ সেবনকারী এবং নেশায় আসক্তদের দ্বারা। ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর স্কেল ৮-৯ সূচক উন্নীত করে বেশি মাত্রার ওষুধ দাবি করাটা একটা নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত ওষুধের কারণে মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে। সঙ্গত কারণেই চিকিৎসকেরা সচেতন হয়ে উঠেন এবং রোগীদের যাচাই বাছাই করা শুরু করেন। এর ফলে ব্যথানাশক প্রেসক্রিপশনের পরিমাণ কমে কিন্তু অন্যদিকে পরিমিত ব্যথানাশক না-পাওয়ায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীদের মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। কিছুদিনের ভেতরেই বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কিছু মামলায় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েক মিলিয়ন ডলারের জরিমানা করা হয়। এবার চিকিৎসক সমাজ উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেন, মামলা এড়াতে বেশিরভাগ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ব্যথানাশক ব্যবস্থাপত্রে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেন। ফলত নারকোটিক প্রেসক্রিপশনের সংখ্যা আবার বাড়তে থাকে, খুব দ্রুত গতিতে। এখানে সেখানে ‘পেইন ক্লিনিক’ গড়ে ওঠে, কিছু মুনাফালোভী চিকিৎসকও সেই দিকে ঝুঁকে পড়েন। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যথানাশক ওষুধের বিরাট বাজার, বছরে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের, যা সারা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। কাজেই এই বাজার দখলের জন্যও প্রতিযোগিতা আছে। ১৯৯৬ সালে পারডিউ ফার্মা নামে একটি কোম্পানি অক্সিকনটিন নামক একটি নারকোটিক ওষুধ বাজারে আনে, যার মাধ্যমে কোম্পানিটি  বছরে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মুনাফা অর্জন করতে থাকে। বাজার বাড়ানোর জন্য কোম্পানিটি নানাবিধ ছলনার আশ্রয় নেয়, ওষুধটিকে আসক্তিহীন বলে ভুয়া প্রচারণা চালায়, চিকিৎসকদের উপঢৌকন ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে এর বিক্রি বাড়ায়। এই একটি ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসক্রিপশন-নারকোটিক-এডিকশন’ জনিত মহামারীর জন্য বহুলাংশে দায়ী, যার পেছনে ছিল বাণিজ্য ও অর্থের লোভ। আদালত কর্তৃক কোম্পানিটি ভেঙে দেয়ার আগে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত অক্সিকনটিন থেকে এর মুনাফা ছিল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। 

অক্সিকনটিন এদেশে বৈধ প্রেসক্রিপশন নারকোটিক আসক্তির জোয়ার আনে। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। মাদকাসক্ত লোকজন এবার চোরাবাজারের হেরোইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং গাঢ় আসক্তির যোগান দিতে ক্রমাগতভাবেই এর মাদকশক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। মাদক ব্যবসায়ীদের উদ্ভাবনী শক্তির কল্যাণে চোরাবাজারে এবার কৃত্রিম নারকোটিক এর আবির্ভাব ঘটে; শুরু হয় আসক্তির পরবর্তী অধ্যায়। প্রচণ্ড উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্রিম মাদকের কবলে পড়ে তরুণ প্রজন্ম। স্বল্প আসক্তিতে কাজ হয় না, ক্রমাগতভাবে এরা উচ্চতর আসক্তির সন্ধানে থাকে। এই পর্যায়েই আসে ফেনটানিলের আসক্তির জোয়ার, যা এখন মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। চীন থেকে কাঁচামাল আসে মেক্সিকোতে, ওখানে ড্রাগ লর্ডদের গোপন কারখানায় পরিশোধিত হয়ে আসল ফেনটানিল চোরাই পথে চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রে। ফেনটানিল হেরোইনের চেয়ে পঞ্চাশ গুণ এবং মরফিনের চেয়ে একশো গুণ শক্তিশালী, অন্যান্য ড্রাগের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয় ড্রাগটির আসক্তি ক্ষমতা। ব্যবহারকারী জানতেও পারে না কী মেশানো হলো।  

দুর্ভাভাগ্যবশত এই মরণ-দ্রব্য ফেনটানিলকে বৈধ উপায়ে বাজারে আনা এবং সহজলভ্য করার পিছনেও দেখি কোম্পানি বাণিজ্যের জঘন্য হাত। এই অপকর্মটির জন্য দায়ী কোম্পানিটির নাম ইনসিস থেরাপিউটিকস (Insys Therapeutics)। বিশুদ্ধ ফেনটানিল হাসপাতালে ব্যবহার করা হয় অচেতনকারী ওষুধ হিসেবে, সার্জারি এবং লাইফ সাপোর্টের সময়। কিন্তু ইনসিস থেরাপিউটিকস এর কর্ণধার জন কাপুর ফেনটানিল এর স্প্রে পেটেন্ট করে বাজারজাত শুরু করেন সাবসিস (Subsys) নামে, মূলত মরণাপন্ন ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্যই এর অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অচিরেই অপব্যবহার শুরু হয়ে যায়। ব্যবহারের ৫ মিনিটের মধ্যেই এর কাজ শুরু হয়ে যায়, ঘন ঘন ব্যবহার করার ফলে রোগীরা দ্রুত আসক্ত হয় পড়েন, তাই ওষুধের মাত্রা বাড়াতে হয় ক্রমাগতভাবে। বাজার দখলের জন্য ভয়ানক আগ্রাসী মাধ্যমের আশ্রয় নেয় কোম্পানিটি। উপঢৌকন এবং অন্যান্য অনৈতিক উপায়ে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি প্রেসক্রিপশন প্রদানকারী ডাক্তারদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়। কম মাত্রায় কাজ হচ্ছে জেনেও অধিকতর দামি বর্ধিত মাত্রার সুপারিশ প্রচার করে চিকিৎসক মহলে। কয়েক বছরের ভেতরেই কোম্পানির মুনাফা তুঙ্গে ওঠে, শেয়ার মূল্য আকাশচুম্বী হয়। একসময় ফেডারেল সরকারের তদন্তে সব অপকর্মের ফিরিস্তি বেরিয়ে আসে, ডাক্তারদের জেল জরিমানা হয়, জন কাপুরসহ কোম্পানির অন্যান্য হর্তাকর্তাদের জেলে ঢুকানো হয়। 

ইনসিস থেরাপিউটিকসের বৈধ প্রেসক্রিপশনে ব্যবহৃত ফান্টানিলই এখন ড্রাগ কার্টেলদের কল্যাণে অবৈধ দ্রব্যের আকারে চোরাবাজারে সয়লাব, যা ইতিহাসের সবচেয়ে মরণঘাতি আসক্তির জন্য দায়ী এবং যার আসল কাঁচামাল পাচার হয়ে আসে সুদূর চীন দেশ থেকে।  

শেষ কথা
চলমান ফানটানিল মহামারীর আর্থসামাজিক ব্যপ্তি সুদূরপ্রসারী। এই মৃত্যূ তরুণ নাগরিকদের, যারা সমাজের ভবিষ্যৎ। ফানটানিল ছাড়াও নানাবিধ আসক্তি নিয়ে বেঁচে আছে যারা, তাদের সংখ্যাও কম নয়। ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমেরিকায় ১২ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যার ৬১ মিলিয়ন (মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ) নেশায় আক্রান্ত। এদের জীবন যাপন বহুলাংশেই মানবেতর। বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ, ‘ফস্টারকেয়ার ক্রাইসিস’-এর বাইরেও আছে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে কর্মবিমুখ কিংবা পুরোপুরি বেকার হয়ে থাকা, চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপরে বাড়তি চাপ; ফুড স্ট্যাম্প, বেকার ভাতা কিংবা অসুস্থ ভাতার ওপর নির্ভরশীলতা, ইত্যাদি। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এবং জয়েন্ট ইকোনোমিক কমিটির গবেষকদের মতে (২০২০ সালের তথ্য) বছরে প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সামাজিক ক্ষতি এই খাতে। এছাড়াও রয়েছে পড়াশোনায় অনীহা, মানসিক অসুস্থতা, গুরুতর অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়া, ইত্যাদি। মোট কথা একটা জাতি ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় সব রসদ আছে এই প্রক্রিয়ায়। 

মার্কিন সরকার এর পেছনে নজর দিচ্ছেন এবং প্রচুর অর্থব্যয় করছেন। কিন্তু সবাই জানে, এতে আশানুরূপ ফল নেই। কেন নেই সেটা খতিয়ে দেখতে গেলেই বুঝা যাবে গলদ। সেনসাস ব্যুরোর পরিসংখানে দেখা যায় মার্কিন জনগোষ্ঠীর ১১.৬% এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতরে প্রায় ১৯.৫% দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস। খাদ্যের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি মার্কিন নাগরিক সরকারের দেয়া ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল। ২০২৩ সালের জরিপে দেখা যায় প্রায় ছয় লক্ষ মার্কিন নাগরিক গৃহহীন। বিভিন্ন জরিপ ও বিশ্লেষণে এও ওঠে এসেছে যে দারিদ্রতা ও গৃহহীনতার পাশাপাশি চলে অপরাধ ও ড্রাগ। কার্যকরভাবে আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে এই বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যা আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। সিনেটর লিন্ডসে মাদক নিয়ন্ত্রণে মেক্সিকোর ভেতরে সৈন্য পাঠানোর হুঙ্কার দিলে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট সরাসরি বলেছেন, মার্কিন জনগণের মাদক গ্রহণের প্রবণতা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ না-করা পর্যন্ত চোরাচালানি নিপাত করা যাবে না। 

মার্কিন সরকারের বিদেশনীতির প্রচুর সমালোচনা ঘরে-বাইরে। এর ভেতরে অন্যতম হলো কথায় কথায় সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দেয়া। কিন্তু সময় এসেছে বুঝার, সব সমস্যার সামরিক সমাধান নেই। আসক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। এ যুদ্ধ ভিনদেশে সৈন্য পাঠানোর নিয়ামক নয়। বরং এ যুদ্ধ অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক যুদ্ধ, যুবসমাজকে হতাশার বলয় থেকে উদ্ধারের যুদ্ধ। রাইফেল নয়, বর্ণ-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসাই এর অস্ত্র। সঙ্গে প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা। প্রায় ২৭ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি’র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই নিশ্চয়তাটুকু সম্ভব নয়—একথা অগ্রহণযোগ্য। 

হুমায়ূন কবির
১১৫ কবির লেন, জেলিকো, টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র।
জুন ১৬, ২০২৩


তথ্যপঞ্জী :
1.    Richard Nixon: Special Message to the Congress on Drug Abuse Prevention and Control. July 17, 1971.
2.    Payan, Tony. A War that can’t be Won. Tuscan, AZ: The University of Arizona Press.
3.    Grinspoon, Lester et al; Feb 3, 1994. “The War on Drugs-A Peace Proposal”. The New England Journal of Medicine. 
4.    Wikipedia. War on drugs.
5.    George F. et al, Oct 29, 2009. A reality check on drug use. The Washington Post
6.    Emergen Research, Health and Pharmaceuticals. 2022-09-12
7.    Wikipedia. Purdue Pharma
8.    Encyclopedia Britannica. Opium Trade
9.    Nic Allen, Bengal Opium: a study in continuity, ENGELSBERG IDEAS, Feb 10, 2023 
10.    The Economic Importance of Indian Opium and Trade with China on Britain’s Economy, 1843 – 1890. Whitman College economics working papers no. 25, spring 2011.
11.    Drugs and Empires: Essays in Modern Imperialism and Intoxication 2500 – 1930, ed. By James H. Mills and Patricia Barton. New York: Palgrave Macmillan, 2007.
12.    Peter Cain and Anthony Hopkins, British Imperialism, 1688-2000. 2nd Edition, New York: Longman, 2001.
13.    National Survey on Drug Use and Health.  U.S Department of Health and Human Services website, January 4, 2023
14.    Homelessness in America 2023: Statistics, Analysis, and Trends. Security.org

menu
menu