বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নে অনুবাদের গুরুত্ব

বৈশ্বিক পটভূমিতে বিশ্বায়ন একটি আধুনিক চটকদার শব্দ। আজকাল এর ব্যবহারও বহুবিস্তৃত। যদিও এই মুহূর্তেও আধুনিক এই বিশ্বে দেশে দেশে যুদ্ধ থেমে নেই। যদিও এক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন এখনো যুদ্ধরত! মারছে মানুষ। মরছে মানুষ। শিশু মরছে। বৃদ্ধ মরছে। বিধ্বস্ত হচ্ছে ভবন, ভৌত অবকাঠামো। দুই পক্ষেই ছুড়ছে সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ছড়াচ্ছে হিংসা। তবু পশ্চিমা শক্তি, উন্নত রাষ্ট্রসমূহ মুখে জয়গানে মুখর রাখছে তাদের মুনাফার বাজার। যার অভিমুখ তৃতীয় বিশ্ব। পুঁজি ও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিস্তৃতি ঘটানোর প্রক্রিয়াকে দূরকে নিকট ও বহুকে একে পরিণত করার নামকরণ করা হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজ। সব দেশ মিলে এক দেশ। এই ধারণার প্রয়োগ থেকেই জন্ম নিয়েছে বিশ্বায়ন।

রোলান্ড রবার্টসন, যিনি বিশ্বায়ন ধারণাটির প্রবর্তক, তিনি বিশ্বায়নকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—‘বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের যোগাযোগ ও পারস্পরিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াই হলো বিশ্বায়ন। সমগ্র পৃথিবীকে পারস্পরিক সম্পর্কের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বায়ন। এর প্রভাব দেশের সীমান্ত, রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, চিরাচরিত ঐতিহ্যকে গুরুত্বহীন করে দেয়।’

ভারতীয় পলিটিকাল ইকোনমিস্ট অমিয় কুমার বাগচী বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বায়ন হলো একটি জগৎব্যাপী প্রক্রিয়া, বিশ্বায়নের এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থা বা এজেন্সি নিজেদের মধ্যে নানাপ্রকার সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশ্বায়নের সংজ্ঞায় অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, যোগাযোগ ও পরিবহন, আমদানি ও রপ্তানি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সকল বিষয় জড়িত। তবে বিশ্বায়ন প্রধানত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ, যেখানে পুঁজি, পণ্য ও বাজার একই সূত্রে গ্রথিত।’ অমিয়কুমার বাগচীর মতে, বিশ্বায়ন কতকগুলো আর্থিক নীতির সমাহার। এই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াটি হলো আসলে বিশ্ব পুঁজিবাদকে আরও সম্প্রসারিত করার একটি প্রক্রিয়া। বিশ্বায়নকে অনেকে নয়া উপনিবেশবাদ হিসাবে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। তাঁরা মনে করেন বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বে নয়া উপনিবেশবাদের কৌশল হিসাবে কাজ করছে।

বামপন্থী সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনৈতিক রাজনীতিবিদগণের চিন্তাধারা এক্ষেত্রে ভ্রান্ত পথে হাঁটছে, এমন কথা না মেনেও বলা যায় আজকের পৃথিবীতে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও পুঁজির বিকাশ আধুনিক বিশ্বকে গতিশীল এবং পারস্পরিক লেনদেনের নানা সম্পর্কে আবদ্ধ রাখছে। পুঁজিবাজারের অর্থনৈতিক লেনদেনের বাইরে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা মেলবন্ধন রাষ্ট্রগুলোকে কাছাকাছি আনছে। নানারৈখিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বিস্তৃতিসাধনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় নানাভাবে অবদান রাখছে। সংস্কৃতির বিভিন্ন বিনিময়ের মাধ্যমে, বিশেষত ক্রীড়ানৈপুণ্যের নানা ক্ষেত্র, সংগীত, চিত্রকলা ও সাহিত্যের আদান প্রদান পারস্পরিক সম্পর্ক জোরালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা অবশ্যই পালন করে আসছে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের মানুষ আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বড় একটি অংশ তাঁরা দেশে পরিজন-স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সবল করছেন, সন্দেহ নেই। অনেকেই বিবেচনা করেন নানা দেশে অভিবাসী বাঙালিদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন ঘটেছে। বাঙালিরা যে দেশেই গেছেন বা যাচ্ছেন, সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য, খাদ্যাভ্যাসসহ সকল সাংস্কৃতিক উপাদান। সন্দেহ নেই মধ্যপ্রাচ্য, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বাঙালি বসবাস করেন এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলেন। অবশ্যই চোখ মেলে দেখলে গত তিন দশকের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, টরেন্টো, লন্ডনসহ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের প্রধান শহর, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইত্যাদি নগর শহরে বাংলায় সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। বাংলা ভাষায় পত্রিকা দেখবেন বাঙালি গ্রোসারিগুলোতে। দু-তিনটি করে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের কথাও জানতে পারবেন। আপনি বেশি কৌতূহলোদ্দীপক হলে কানে শুনবেন বাংলা গান বাজছে কোন রেডিও স্টেশনে।

এসব অনেকের মনেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। এসব দেশে অভিবাসন শুরুর তিন দশক, সাড়ে তিন দশক বয়স হতে চলল। ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ বছরে অভিবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। এই জনসমষ্টির জন্যে চাই নিজস্ব খাদ্য, পোশাক, রুচির অভ্যস্ত জীবনকে অনেকটা ফিরিয়ে আনা। তাই ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গ আর্থিক মুনাফার হিসাব মাথায় রেখেই ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন এবং ব্যবসার সুবিধার কারণেই বাংলা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এও সত্যি যে, এসবের সঙ্গে পিছুটান ও দেশপ্রেমের আবেগের স্পর্শও লেগে থাকে। তবে প্রয়োজন ও ব্যবসাটাই মুখ্য। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষা ও পাঠদানের জন্যেও একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। গড়ে ওঠে সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য সংগঠনও গড়ে ওঠে একের পর এক। অনুষ্ঠানও হয় একের পর এক। কিন্তু সবই নিজেদের মধ্যে। ঘুরে ঘুরে একই সব চেনা মুখ। একবার নাচে, একবার অভিনয়ের মঞ্চে, আরেকবার আবৃত্তিতে। কখনো পারফর্মার, কখনো দর্শক সারিতে বসা। এভাবেই চলতে থাকে পৌনঃপুনিক।

এতে আর যাই হোক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ হয় না। যে বাঙালি নিউইয়র্ক বা লন্ডনে বসে বাংলা বলছেন, তিনি বাংলাদেশে বাংলা ভাষাতেই কথা বলতেন। যে বাঙালি প্রজন্ম ইতালি বা অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় জন্ম নিয়ে বাংলা বলছে, তাঁদের জন্ম বাংলাদেশে হলে তারা বাংলাতেই কথা বলত। বরং আমেরিকা, কানাডায় বসবাসকারী একদল উন্নাসিক মানুষ যথার্থ কারণ ছাড়াই নিজেরাও অপ্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে বা পরিবারে ইংরেজিতে কথা বলেন। ছেলেমেয়েদেরকেও সেভাবেই শেখান। সুতরাং সেদিক বিবেচনায় বাংলা ভাষা বলার মানুষ বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায় কমছে। আর বিশ্বায়ন, সে তো দূরস্থান! আশ্রয় গ্রহণ যে দেশে, সে দেশের মানুষদের বাংলা গ্রহণ তো দূরের কথা, বাংলা ভাষার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ তাঁদের নেই, স্থাপিত হচ্ছে না। বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন বলতে আমরা কী বুঝব? বাংলা সাহিত্যের বই পত্রপত্রিকার দোকান বিদেশে হওয়া, শাড়ি-চুরি-গহনার দোকানের সঙ্গে বইয়ের দোকান সাজিয়ে বইমেলার আয়োজন করা, যার আয়োজক, দর্শক, শ্রোতা, অংশগ্রহণকারী সবাই বাংলা ভাষাভাষী?

বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন সম্ভব শুধুমাত্র অন্য ভাষাভাষীদেরকে বাংলা সাহিত্য পাঠে আগ্রহী করে তোলায়। অন্য ভাষাভাষীদের হাতে বাংলা বই তুলে দিতে হলে দিতে হবে যাকে দেব, তার ভাষায়। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি পঠিত, কিংবা পড়তে, বুঝতে সক্ষম ইংরেজি ভাষায়। আর সেটা কেবল করা সম্ভব অনুবাদের মাধ্যমে। বাংলা একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষায় কথা বলে এবং এটি প্রধান ভাষা বলে বিবেচিত, এমন মানুষ পৃথিবীতে বিশাল সংখ্যক। বাংলা ভাষার সাহিত্যও প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের চর্যাপদ ও মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল-সহ, আলাওলের পদ্মাবতী এবং ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলো সাহিত্যমূল্যে সমৃদ্ধ। আমাদের বাংলার বাউল ও সুফি গানের কথাও আমরা উদ্ধৃত করতে পারি এ প্রসঙ্গে। এসব সাহিত্যের যথার্থ অনুবাদ প্রয়োজন। প্রয়োজন অনূদিত বাংলা সাহিত্যের বহুমূল্য সম্পদ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয়া। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রথম অনুবাদ করেন গীতাঞ্জলি। ফলও ফলে তার। তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হন। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় নানা ভাষায়, জাপানি ও চীনা ভাষায় তাঁর রচনা অনূদিত হয়। রবীন্দ্রোত্তর যতদূর জানা যায় ভারতীয় ইংরেজ পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এবং কবিতার কিছু অংশ অনুবাদ করেছিল। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড তাঁর চারটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিল। পরবর্তী সময়ে উইলিয়াম রাদিচে নজরুলের কিছু কবিতার ইংরেজি ভাষান্তর করেছিলেন। নজরুল ইনস্টিটিউটও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করিয়েছে।

স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতাত্তোর কালে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদে বাংলা একাডেমি মূলত ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ইউপিএল (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চারটি উপন্যাস বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশ করেছে রাইটার্স ইঙ্ক। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদকৃত কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ—শওকত ওসমানের রাজা উপাখ্যান, আহমদ ছফার ওঙ্কার, সেলিনা হোসেনের পূর্ণ ছবির মগ্নতা, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন, হাসান আজিজুল হকের নির্বাচিত গল্প, শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক, এছাড়াও সুফিয়া কামাল, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সাঈদ আহমদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখের বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। আলাউদ্দীন আল আজাদের ২৩ নম্বর তৈলচিত্র, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, নীলিমা ইব্রাহীমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি প্রভৃতি গ্রন্থ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

ভারতের পশ্চিমবাংলা থেকে বলাই বাহুল্য অনেক বিখ্যাত লেখকের প্রসিদ্ধ সব উপন্যাস ও বিখ্যাত অন্য গ্রন্থের ইংরেজি ভাষান্তর প্রকাশিত হয়েছে এবং নিয়মিত হয়ে আসছে। ভারতে অনুবাদের ক্ষেত্র বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য রচনাও ইংরেজি অনুবাদকরণের জন্য আর্থিক বরাদ্দ দিয়ে কমিশন গঠনে অনুবাদক নিযুক্ত করে অনুবাদকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। সেজন্যে তাঁদের ইংরেজি অনুবাদকর্ম ও তার মান যথেষ্ট এগিয়ে। তবে তাঁরা অনেক সময় বাংলাদেশের সাহিত্যিকের কোনো কোনো সাহিত্যকর্মের ইংরেজি ভাষান্তর করে থাকেন। আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ প্রয়োগ থাকায়, সেসবের সঠিক অর্থ না জানায় এবং সেসব অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন, মুখের ভাষা সম্যক জানা না থাকায় অনেক সময় সঠিক অনুবাদ হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের অনুবাদকর্ম বাংলাদেশের লেখক ও পেশাদার দক্ষ অনুবাদকদেরই করতে হবে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদে খান সারোয়ার মোর্শেদ, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, ফকরুল আলম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, আজফার হোসেন, শওকত হুসাইন, সুব্রত কুমার দাস, মোস্তাইন বিল্লাহ, আফসান চৌধুরী প্রমুখ অবদান রেখেছেন।

বাংলা একাডেমির অনুবাদ প্রকল্পকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। শোনা যাচ্ছে বাংলা একাডেমির অনুবাদ পত্রিকা পুনরায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এটি একটি আশার সংবাদ। বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলা একাডেমিকে অগ্রণী ভূমিকা পালনে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাসম্ভারকে পেশাদার, দক্ষ খুব ভালো ইংরেজি ও প্রধান প্রধান বিদেশি ভাষার সাহিত্যে দখলদার জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গকে অনুবাদের দায়িত্ব প্রদানে অনুবাদকর্মকে যথাসম্ভব পাঠক সম্মুখে উপস্থাপনে উদ্যোগী হতে হবে। এসব অনূদিত বই ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাসহ বৃহত্তর পরিবেশে আন্তর্জাতিক বইমেলাসমূহে প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্যে অংশ নিতে হবে। আরেকটি আশার ক্ষেত্র সরাসরি ইংরেজি ভাষায় লেখা। এক্ষেত্রে অভিবাসী লেখকগণ ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী, রহিন্তন মিস্ত্রী, জিয়া হায়দার, কেতকী কুশারি ডাইসন প্রমুখ ও আরও অনেকে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁরা তাঁদের লেখাকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। অভিবাসী লেখক ও কবিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণ শ্রেণির একদল প্রয়াসী হয়েছেন ইংরেজি ভাষায় সরাসরি লিখতে। আবার কেউ কেউ নিজের লেখা কবিতার অনুবাদ করে কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ ও বাজারজাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটি ইতিবাচক। সকলেই হয়তো কৃতকার্য হবেন না। তবে উদীয়মানদের মধ্যে কারও কারও নাম উঠে আসছে। নিশ্চয়ই একদিন তাঁরা তাঁদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বাংলাদেশের সাহিত্যসম্ভারকে মর্যাদায় অভিষিক্ত করাবেন।

যাঁরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকেন, তাঁরা যদি সেসব ইংরেজিতেও বা দ্বিভাষিক উপস্থাপন করেন এবং সেসব অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের (ইংরেজি ও অন্যভাষী) আমন্ত্রণ করেন এবং নিজেরাও মূলধারার অনুষ্ঠানসমূহে অংশীদারিত্ব নেন ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপনের মাধ্যমে (ইতোমধ্যে খুব স্বল্প পরিসরে তা শুরু হয়েছেও, আশা রাখি ক্রমান্বয়েই অংশগ্রহণ সংখ্যা বাড়বে) তবে, অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। দেশে এবং বহির্বিশ্বে দুই ক্ষেত্রেই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদকে এগিয়ে নিতে ভাষান্তরের আশ্রয় নিতেই হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজিতে লেখার চর্চাকে এগিয়ে নিতে হবে। দুই ক্ষেত্রেই সরকারকে জোরালো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি ভাষা ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। অনুবাদ সাহিত্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে কমিশন গঠনে দক্ষ অনুবাদক নিয়োগের মাধ্যমে নিয়মিত অনুবাদ কাজ করাতে হবে এবং সেগুলোর আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলোতে প্রদর্শন ও বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে এসব কাজে দূতাবাসগুলোকেও দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে। কারণ সাহিত্যের বিনিময় দেশে দেশে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এভাবেই বাংলা ভাষার সাহিত্য নিকট ভবিষ্যতে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের পাঠক সমালোচকের পাঠমনোযোগিতায় ঠাঁই করে নেবে এবং মর্যাদাসিক্ত হবে।


ফারুক ফয়সল প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক। প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ চারটি। দু’টি প্রবন্ধ গ্রন্থ—অসুস্থ সমাজ : প্রাসঙ্গিক ভাবনা,  ধর্মীয় সহাবস্থান বনাম মৌলবাদ ও অন্যবিধ প্রসঙ্গ। উপন্যাস : নতুন প্রাণের চর। কাব্যগ্রন্থ : সীমানাহীন স্বপ্নেরা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।

menu
menu