ছিন্নমস্তা ভয়ঙ্করী না করুণাময়ী?

প্রাচীন সনাতনী পুরাণে বর্ণিত রয়েছে দেব দেবীদের নিয়ে অসংখ্য কথকতা। প্রাচীন পুরাণ গুলি সংখ্যায় ১৮টি। এর মধ্যে অন্যতম একটি পুরাণ হলো মার্কণ্ডেয় পুরাণ, যা ঋষি মার্কণ্ডেয় রচনা করেছিলেন দেবী আদিশক্তি মহামায়ার লীলা বর্ণনা করে। এই নিবন্ধে বিরাট মার্কণ্ডেয় পুরাণ সম্বন্ধে বলা টা বাতুলতা হয়ে যাবে। তাই আমরা চলে যাবো সেই জায়গায় যেখানে দেবীর দশ মহাবিদ্যার বর্ণনা পেয়ে থাকি।

দেবী আদিশক্তি যখন প্রজাপতি দক্ষর কন্যা দাক্ষায়নী রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তখন তিনি তাঁর পিতার অমতে শিবের সঙ্গে পরিণয় সম্পন্ন করায় প্রজাপতি দক্ষ তাঁর কন্যার প্রতি এতটাই বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়লেন যে সব রকম সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে তাকে শিব সহ ব্রাত্য করে দিয়েছিলেন। ফলে যখন তিনি এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন তখন সতী সহ শিব সেখানে কোনো নিমন্ত্রণ পেলেন না। বিনা নিমন্ত্রণে দেবী সেই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে যেতে চাইলে শিব তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। বহু অনুনয়ের পরেও শিব রাজি না হলে সতী তাঁর দশটি রূপ ধরে শিব এর পথ দশদিক দিয়ে রোধ করে দাঁড়ালেন। পুরাণে এই দশ রূপই দেবীর দশ মহাবিদ্যা নামে পরিচিত।

মহাবিদ্যা অর্থে মহৎ বিদ্যা।এই মহাবিদ্যারা হলেন যথাক্রমে - কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধুমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা। আমরা যদি একটু গভীরে গিয়ে আলোচনা করি তাহলে দেখবো এই মহাবিদ্যার প্রতিটি রূপ এ আসলে কিছু গুণ বিশেষ। যেমন কালী বলতে প্রথমেই আমাদের মনে আসে কাল এর কথা কাল অর্থে সময় অর্থাৎ যিনি কালের ও উপরে তিনিই কালী। তাই তো তিনি মহাকাল বা শিব কে নিজের পায়ের তলায় রাখতে পারেন।

আমরা এই নিবন্ধে কেবল দেবীর ছিন্নমস্তা রূপটি কিছু আলোচনা করবো। বড়ো অদ্ভুত দেবীর এই রূপ একই সাথে যা ভয় ও বিস্ময় জাগায় মনে।এই দেবীর গায়ের রং লাল তিনি নিজেই নিজের মাথা কেটে তাঁর ডান হাতে ধরে রয়েছেন এবং তাঁর অন্য হাতে ধরা একটি খড়্গ। তাঁর ছিন্ন গলা থেকে তিনটি ধারায় রক্ত বেরিয়ে আসছে যা পান করছেন তাঁর দুই পাশে অবস্থানরত সখী জয়া ও বিজয়া (এরা আবার ডাকিনি ও বর্ণিণী নামেও পরিচিত) এবং তিনি স্বয়ং। তাঁর পায়ের তলায় তিনি সঙ্গমরত এক যুগল কে চেপে রেখেছেন। বৌদ্ধ তন্ত্রযান এও এই দেবীর উল্লেখ আছে সেখানে তিনি পরিচিতা দেবী বজ্রযোগিনী নামে। দেবী ছিন্নমস্তার উদ্ভবের দুটি কাহিনী প্রধানত আমরা দেখতে পাই। ‘রেণুকা তন্ত্রে’ দেখা যায় অসুরদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দেবী প্রচন্ড বীভৎস হয়ে ওঠেন এবং তাঁর এই বীভৎসতা প্রশমিত করতে দেব ব্রহ্মা কামদেব কে পাঠান দেবীর মধ্যে কাম ভাব জাগিয়ে তাঁর ভয়ানক রূপ কে শান্ত করতে। কিন্তু দেবীর উদ্দেশে কামদেব তাঁর মদনবাণ প্রয়োগ করতে গেলে দেবী পাল্টা কামদেবের দিকে সেই বাণ নিঃক্ষেপ করেন ফলে কামদেব নিজেই কামে আসক্ত হয়ে সেই স্থানেই নিজের স্ত্রী রতির সাথে সংগমে লিপ্ত হন। এই অবস্থায় দেবী নিজে সেই সংগমরত যুগল এর উপর নিজের পা রেখে দাঁড়ান। তখন তাঁর দুই সখী তাঁর কাছে ক্ষিধায় কাতর হয়ে খাদ্য চাইলে দেবী নিজের মুণ্ড ছেদন করেন এবং তাঁর গলা থেকে নিঃসৃত রক্ত তাঁর দুই সখীসহ নিজে পান করতে থাকেন।

অপর একটি মত ‘নারদ পঞ্চরাত্র’ অনুযায়ী দেবী পার্বতী একবার সখীগণ সমেত মন্দাকিনী তে স্নান করতে যান। এবং স্নান শেষে তিনজনেই ভীষণ ক্ষিধায় কাতর হয়ে পড়েন। তখন সখীদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দেবী তাঁদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নিজের মাথা নখের দ্বারা ছিঁড়ে ফেলেন ও ছিন্ন মাথাটি হাতে ধারণ করে কাটা ধড়ের থেকে নির্গত রক্ত সখীদের সঙ্গে পান করতে থাকেন।

দেবীর এই রূপটি দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখবো এখানে দেবী নিজে অহং কে ত্যাগ করেছেন অর্থাৎ আমাদের মাথা যা আমাদের বিচার বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতীক তিনি তা স্বহস্তে কেটে ফেলেছেন এবং অন্তরের জ্ঞান যা রক্ত রূপে নির্গত হচ্ছে তা তিনি গ্রহণ করছেন। অহংকাররহিত হয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞানই গ্রহণযোগ্য তা ই দেবীর এই রূপের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

এছাড়াও আর একটি দিক আমরা লক্ষ্য করি যে আদিশক্তি স্বয়ং প্রকৃতির স্বরূপ তিনি নিজেই ভোজ্য এবং নিজেই তার ভোক্তা।দেবীর কামরত যুগল এর উপর অবস্থান এটাই বোঝায় যে ইন্দ্রিয় সুখ বা পার্থিব কামনাকে দমন করে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া।

আমরা যোগশাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের তিন প্রধান নাড়ির কথা জানতে পারি যা হলো ঈড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। দেবীর দুই পাশে অবস্থানকারী তাঁর দুই সখী জয়া ও বিজয়া বা ডাকিনি ও বর্ণিণী যথাক্রমে তামসিক ও রাজসিক গুনের প্রতীক এবং মাঝে নিজ ছিন্নমুন্ড ধারণকারী দেবী নিজে স্বয়ং সত্ত্বগুণের প্রতীক।
দেবীর এই রূপ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই ভয়ানক হোক না কেন আমরা এই রূপের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেখতে পাই এই রূপ জন্ম ও মৃত্যুর প্রবাহ থেকে মুক্তির প্রতীক। তিনি একদিকে যেমন প্রাণ হরণ করেন তেমনি তিনি প্রাণরক্ষাও করেন। তাঁর ছিন্ন ধড় থেকে নির্গত রক্ত দ্বারা তাঁর সখীদের ক্ষুদার নিবারণ এই প্রাণ রক্ষারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেবীর এই মহাবিদ্যা রূপটি ভয়ানক ও করুণাময়ী এই দ্বৈত সত্তার ভারসাম্যরই প্রতীক। 

তথ্যসূত্র  
১. অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র
২. চিহ্নতত্ত্বের আলোয় পুরাণ, দেবলীনা রায় চৌধুরী
৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত। 


অয়ন দাস প্রাবন্ধিক। তিনি ইতিহাসে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর; পুরাণ নিয়ে লিখতেই পছন্দ করেন, এবং পুরাণ ছোটকাগজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।

menu
menu