বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট

আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক বহুমুখী সমস্যা বর্তমানে বিশ্বের প্রাকৃতিক স্থিতিশীলতাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট নজিরবিহীন জনস্বাস্থ্য সমস্যা, রাজনৈতিক মেরুকরণ, আভ্যন্তরীণ আন্তঃদেশীয় সংঘাত বিশ্ব পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে। তার সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ এক খাদ্য সংকট। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি’র লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে ক্ষুধা এবং দারিদ্র মুক্ত করা। বর্তমান খাদ্যদ্রবের মজুত এবং সরবরাহের হিসাব আমলে নিলে সেই লক্ষ্য অর্জন অধরাই থেকে যাবে বলেই অনেকের ধারণা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে রয়েছে বা যারা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন এমন লোকের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ১৩.৫০ কোটি যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪.৫ কোটিতে। বিশ্বের ৮২.৮০ কোটি মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায় এবং প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কিনারায় অবস্থান করছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ যারা খাদ্যের পরিমাণ বা গুণমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটি।

তবে খাদ্য সংকটের ভয়াবহতা সব দেশের জন্যে সমান নয়। দরিদ্র এবং সংঘাত-পীড়িত অঞ্চলগুলিতে খাদ্য সংকটের তীব্রতা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি এবং এইসব অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী দিনগুলিতে। বিশেষ করে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া এবং ইয়েমেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই দেশগুলোর ১০ লক্ষ লোক বিপর্যয়কর মাত্রার ক্ষুধার সম্মুখীন। এছাড়াও  কঙ্গো, হাইতি, কেনিয়ার খাদ্য সংকট ক্রমেই অবনতিশীল এবং তাদের অবস্থাও উদ্বেগজনক। 

বাংলাদেশের খাদ্য সংকট উপরের উল্লেখিত দেশগুলোর মতো নাজুক না হলেও অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে জনগণের খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্যে বাংলাদেশকে অন্য দেশের সহায়তার প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে দেশে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ছয় শতাংশ মানুষের খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।

গত বছর এই সংখ্যাটা ছিল পাঁচ শতাংশ। এই সমীক্ষা আরও দেখায় যে ২৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা গত বছরের জুনে ছিল এক শতাংশ যা চলতি বছরের মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই শতাংশে। পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ঘাটতির কারণে গমের আটা, ভোজ্য তেল, চিনি সহ গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সামগ্রীর অভ্যন্তরীণ দাম অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল বছরজুড়ে। অনুমান করা হচ্ছে যে গত বছরের তুলনায় এ বছর চাল, গম এবং ভুট্টার উৎপাদন শূন্য দশমিক চার শতাংশ হারে  হ্রাস পেতে পারে যা খাদ্য ঘাটতির নাজুক পরিস্থিতিকে আর প্রকট করে তুলবে। 

যদিও সাম্প্রতিক খাদ্য সংকটের জন্য প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, তবে এই সংকটের মুলে রয়েছে মৌলিক তিনটি কারণ: জলবায়ুর পরিবর্তন, জাতিগত সংঘাত, এবং কোভিড পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। এই ঘটনাগুলোর যুগপৎ উপস্থিতি সাধারণ মানুষের জীবনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম যা মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।। এই সমস্যা মানব জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে—যেমন খাদ্যের সংস্থান, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ইত্যাদি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দিনে দিনে যেমন মারাত্মক আকার ধারণ করছে, তেমনি তার ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতি তীব্রতর হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাস করে, যেখানে মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্যে অনেকটাই কৃষির উপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে ফসল সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে বছরের পর বছর। যার কারণে এই অঞ্চলগুলো আবহাওয়া-সম্পর্কিত দুর্ভিক্ষের প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে।

বন্যা, খরা, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়, সুনামি, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে মানুষকে বাস্তুচ্যুতি করছে। এই দুইয়ের প্রভাব কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বিধ্বংসী বন্যা শুধু এই বছরই পাকিস্তানে প্রায় ৩০ লাখ লোককে প্রভাবিত করেছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। দক্ষিণ সুদান টানা চতুর্থ বারের মত চরম বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে সিরিয়ায় গত তিন বছর যাবৎ গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে লা নিনার বৈরী প্রভাব অব্যাহত রয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছে মারাত্মকভাবে।

প্রয়োজনের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত এবং ভূগর্ভস্থ পানির অধিকহারে উত্তোলন পানির স্তরকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং পশুপালনে। আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এক রিপোর্টে দেখিয়েছে যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা  যদি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তবে গবাদিপশু উৎপাদন হ্রাস পাবে ৭-১০ শতাংশ। এর সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে ৯৭০ কোটি থেকে ১২৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এই পরিসংখ্যানে এটাই প্রতীয়মান হয় যে জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে মারাত্মক হুমকি।    

বর্তমান খাদ্য সংকটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে চরমভাবে, কারণ করোনা সংক্রমণ রোধে বিশ্বের প্রায় সব দেশই লক-ডাউন, বাসা থেকে অফিস, এবং শিল্পের উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধ রাখা হয় অনেকটা সময় ধরে। আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে অনেক লোক দারিদ্রসীমার নিচে চলে যায়। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে মহামারীজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটে পতিত লোকের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি বেড়ে ৭৭ কোটিতে পৌঁছেছে, যা ২০০৬ সালের পর এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি।

কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেশগুলি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর করতে বাধ্য করেছে, যার ফলে প্রধান খাদ্য-দ্রব্যের চাহিদা বেড়েছে। এই সাথে তাল মিলিয়ে সরবরাহ বাড়েনি বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে অনেকগুণ। গম এবং সার সরবরাহের ঘাটতিতে খাদ্য নিরাপত্তায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির জন্য আমদানি বিল বেড়েছে দুই হাজার পাঁচশত কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা বিশ্বের প্রায় ১৭০ কোটি  মানুষকে ক্ষুধার্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে। অধিকন্তু, প্রাক-মহামারী পরিস্থিতিতে ফিরে আসার চেষ্টায় দেশগুলো মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার ফলে পরিবহন খরচ বেড়েছে অনেকগুণ। পরিসংখ্যান দেখায় যে সরবরাহ-শৃঙ্খল সমস্যা এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে উন্নীত করেছে। বিশ্বের ৩৬টি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ বা তার বেশি, যা দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য—যারা তাদের আয়ের অর্ধেকের বেশি খাবারে ব্যয় করে—বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলির ৬০ শতাংশই ঋণের জালে জর্জরিত বা ঋণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রয়েছে, যা ২০১৫ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।

অপ্রত্যাশিত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং কোভিড-১৯ মহামারীর পাশাপাশি, স্থানীয় এবং দীর্ঘায়িত জাতিগত সংঘাতও বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্য সংকটের মূল কারণ। সহিংস সংঘাত আফ্রিকান দেশগুলির জন্য খাদ্য সংকটের মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবজারভার রিজার্ভ ফাউন্ডেশন এর পরিসংখ্যান  মতে, বিশ্বের ক্ষুধার্তদের ৬০ শতাংশই সহিংস ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে বসবাস করে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির নতুন মেরুকরণ যেমন রাজনীতিতে রক্ষণশীলদের উত্থান, চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ, এবং সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে এই পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। ইউক্রেন বিশ্বের রুটির বাস্কেট হিসাবে পরিচিত। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। বিশ্বের ৫০টি দেশ তাদের দরকারি খাদ্যশস্যের অন্তত ৩০ শতাংশ ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে আমদানির করে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশ তাদের দরকারি খাদ্যশস্যের অর্ধেকেরও বেশি আমদানি করে পৃথিবীর শস্য ভাণ্ডার খ্যাত এই দুই দেশ থেকে।

যুদ্ধ-পূর্ব রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বের মোট গম এবং বার্লির চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ একাই যোগান দিয়েছিল। খাদ্য সংকটে ঝুঁকিপূর্ণ এবং দরিদ্র ৩৬টি দেশ তাদের গমের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ রাশিয়া বা ইউক্রেনীয় খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল তাদের এখন হঠাৎ করে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া মত দূর দেশে ঝুঁকতে হচ্ছে। দূরত্বের কারণে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে হুহু করে। এছাড়াও নাইট্রোজেন সার রপ্তানিতে রাশিয়া বিশ্বে প্রথম, পটাসিয়াম সারে দ্বিতীয়, এবং ফসফরাস সারে তৃতীয়। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি এইসব রাসায়নিক উপাদান রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাশিয়া যুদ্ধের ফলাফল নিজের দিকে টানতে চেষ্টা করছে। আর তার বৈরি প্রভাব পরছে বিশ্বের খাদ্যশস্য উৎপাদনে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই সারের দাম বেশি ছিল। যুদ্ধ সেই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য নিরাপত্তার উপর।

উপরে উল্লেখিত তিনটি প্রধান কারণের পাশাপাশি খাদ্য সংকটকে তীব্রতর করেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার লোভ। অনেকের মতে, বর্তমান খাদ্য সংকট সত্যিকার অর্থে উৎপাদন স্বল্পতা নয় বরং ক্রয়ক্ষমতার সংকট। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট যত প্রকট, খাদ্যের মজুত তত কম নয়। খাদ্য দ্রব্যের বাণিজ্যিক সরবরাহ গুটি কয়েক কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত। খাদ্যের মূল্যের উপর তাদের প্রত্যক্ষ  নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এইসব বাণিজ্যিক এবং ভাড়াটিয়া শ্রেণির (রেন্টিয়ার ক্লাস) উত্থান, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত মুনাফা করে, বিশ্বব্যাপী চলমান খাদ্য সংকটে আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। 
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে ব্যহত করে এমন সব বাঁধা দূর করতে হবে। যেহেতু খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের প্রধান বাঁধাগুলো মানবসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক, তাই খাদ্য সংকট সমাধানে প্রধান দুটি বিষয়ের উপর জোর দিতে হবে : নিরসন (মিটিগেশন) এবং অভিযোজন (এডাপটেশন)। কোভিড-১৯ এর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব নয়। তাই এইসব দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট নতুন স্বাভাবিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াই হবে প্রধান লক্ষ্য। আর মানবসৃষ্ট সংকট প্রশমিত করতে হবে।

খাদ্য সংকট সমাধানের প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হবে পরিবেশের বিপর্যয় রোধ করা। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক উৎস হলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন যা প্রধানত ক্রমবর্ধমান নগরায়ন এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ফল। যেহেতু নগরায়ন ও বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বন্টন আধুনিক জীবন ব্যবস্থার পূর্বশর্ত, তাই এগুলোকে বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু, অর্থনীতির সম্ভাব্য সব সেক্টরে আধুনিক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি স্থাপন এবং সংযোজন করতে হবে। অনুন্নত দেশগুলির পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি বিকাশের নিজস্ব ক্ষমতা নেই। তাই, উন্নত দেশগুলি, যারা ইতিমধ্যেই বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ কার্বন মজুত করেছে, তাদের অবশ্যই পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির বিকাশের নেতৃত্ব দিতে হবে এবং সেগুলিকে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিতে স্থানান্তর করতে হবে। অধিকন্তু, জলবায়ু-সহনশীল ফসলের উদ্ভাবন এবং চাষে মনোযোগী হলে খাদ্য শস্যের উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে।

এ ছাড়া জাতিগত ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে অস্ত্র ও বল প্রয়োগের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। উল্লেখ্য যে যুদ্ধ, তীব্রতা যত কম বেশিই হউক না কেন, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে অনেক বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অধিকন্তু যুদ্ধ একটি পরিবেশ বিপর্যয়কারী ঘটনা। এটি পরিবেশকে দূষিত করে মারাত্মকভাবে, মানুষকে তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে স্থানচ্যুত করে, এবং খাদ্য উৎপাদন ও বন্টন ব্যাহত করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্য সরবরাহের মূল শৃঙ্খলকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিশ্বজুড়ে পণ্য সরবরাহ কাজে নিয়োজিত পরিবহন এবং স্বাভাবিক চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্থ করেছে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্য, জ্বালানী এবং সারের পরিবহন এবং বিপণন কাজে ব্যবহৃত এইসব রুট উন্মুক্ত রাখতে হবে। সেই সাথে খাদ্যশস্য সংরক্ষণে বড় আকারের গুদামঘরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্বলতার অজুহাতে খাদ্যশস্যের মজুদ এবং অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি সহ অনৈতিক কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট এড়াতে অর্থনৈতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নৈতিক অনুশীলন বজায় রাখতে হবে। মানুষের অসহায়তার অজুহাতে অযৌক্তিক মুনাফা করে এমন কোম্পানিগুলোকে উচ্চ করের আওতায় আনা যেতে পারে। আর এই কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করে এমন সব কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে, যেমন ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন, সেসব প্রতিষ্ঠানে এই কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ অনুদান হিসেবে দান করলে প্রান্তিক মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা বাড়বে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো মানবসৃষ্ট সংঘাতে কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যেন খাদ্য সরবরাহকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় অনেক দেশই খাদ্য রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে থাকে যাতে নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাঘাত না ঘটে। এই ধরনের পদক্ষেপ পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে আরও খারাপ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালে ইউক্রেন যখন অভ্যন্তরীণ মূল্য রক্ষার জন্য গম, বার্লি, রাই এবং ভুট্টার ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, রাশিয়া এবং কাজাখস্তান একই নীতি অনুসরণ করেছিল। এই বাণিজ্য বিধিনিষেধের কারণে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী গমের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, যার ফলে খাদ্য আমদানি করে এমন কয়েকটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে। সম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে এই পর্যন্ত ২৩টি দেশ খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতে পারে। বিশ্বের তিনটি দেশ, চীন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, অনেক বড় পরিমাণে খাদ্য মজুত করে থাকে। দুর্যোগের সময় এইসব দেশ যেন আন্তর্জাতিক বাজারে শস্যের মজুদ ছেড়ে দেয় সেইজন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। এতে করে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাবে অনেকটাই। 

খাদ্য নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকারের একদম উপরের স্তর। খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোন উপায় মানুষের জানা নেই। প্রাকৃতিক এবং মানব-সৃষ্ট কিছু কারণে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত কার্বন নিঃসরণ, জাতিগত সংঘাত, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের যুগপৎ উপস্থিতি বিশ্বকে এক অভূতপূর্ব খাদ্য সংকটের মুখোমুখি করেছে, যা আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের, লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে বিশ্ব খাদ্য ভাণ্ডারে ধনী গরিব নির্বিশেষে সব শ্রেণির লোকের নূন্যতম একটা অ্যাক্সেস থাকা বাঞ্ছনীয়। এই মর্মে খাদ্য উৎপাদন এবং সুষম বণ্টনের পথে কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক যত বাঁধা আছে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে মানুষ আজ মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বিজ্ঞানের উন্নয়নের এই ধারা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজে লাগাতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির সদ্ব্যবহার, উন্নতজাতের বীজের আবিষ্কার, জলবায়ু সহনশীল কৃষির প্রচলন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎসাহিত করা সহ এইসব প্রযুক্তি অনুন্নত দেশের জন্যে সহজলভ্য করতে উন্নয়নশীল দেশের এগিয়ে আসতে হবে। তদুপরি, মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান, খাদ্যদ্রব্যের উপর যেন কতিপয় গুষ্টির নিয়ন্ত্রণ না থাকে সেদিকে যথাযথ দৃষ্টি দিলে অনাহারে এবং অর্ধাহারে মানব মৃত্যুর মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে বিলুপ্ত হবে।    
 


মোহাম্মদ দুলাল মিয়া প্রাবন্ধিক। তিনি ওমানের নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও ফিন্যান্স বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি দুইটি বইয়ের লেখক (একটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত) এবং সম্পাদনা করেছেন তিনটি বই। 

menu
menu