ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি :  একটি প্রাথমিক পাঠ

বাংলা শব্দের অর্থ নিরুপণের জন্য অনেক রকম অভিধান আছে। এই অভিধানগুলোতে একটি শব্দের নির্দিষ্ট অর্থের পাশাপাশি এর সমার্থকশব্দগুলোও জেনে নেয়া যায়। তবে ব্যতিক্রম হলো হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বঙ্গীয় শব্দকোষ। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী প্রণীত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ নির্ণয়ের উৎস হিসেবে এ অভিধানের গুরুত্ব রয়েছে। শব্দের অর্থ নির্ণয়ে হরিচরণের ধারণাকে কাছে রেখে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী যে নতুন দার্শনিক প্রকল্প গড়ে তোলেন তা হলো ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি’। এর মূল কারিগর কলিম খান। তিনিই এ ধারণার সূত্রপাত ঘটান। পরে তার সাথে যুক্ত হন রবি চক্রবর্তী। এই প্রকল্পের আউটপুট হলো বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও সরল শব্দার্থকোষ

কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী পৃথকভাবে গ্রন্থ রচনা করার পাশাপাশি এককভাবেও কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে তাদের মূল কাজ বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ ও সরল শব্দার্থকোষ। দীর্ঘ শ্রম ও সাধনার ভেতর দিয়ে তারা শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ নির্ণয় করে এ অভিধান দুটি প্রণয়ন করেছেন। এ বিষয়ক বিভিন্ন রচনায় তারা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ এর কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তারা যে সেক্টরে কাজ করেছেন হরিচরণ ছাড়া কেউ এ বিষয়ে কাজ করেননি। যদিও হরিচরণের সাথে তাদের কাজের কিছু মৌলিক এবং স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে তবু তারা নিজেদেরকে হরিচরণের ‘উত্তরসূরি’ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। বস্তুত তারা হরিচরণের ধারণাগুলোকে আরও পরিশুদ্ধ ও সূক্ষ্ম করে শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ নির্ণয়ের দিকে এগিয়ে যান।
 

ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি আমাদেরকে এক নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়। তাদের এ প্রকল্প পাঠান্তে আমাদের মনোযোগ শব্দের প্রচলিত অর্থের (প্রতীকী অর্থ) দিকে না গিয়ে যায় শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক উৎসের দিকে। এই বিধি দেখাতে সমর্থ হয়েছে প্রতিটি শব্দ এমনকি প্রতিটি বর্ণের মূলে আছে ক্রিয়া। ফলে কলিম খানকে পাঠ করার পরে শব্দের অর্থ খোঁজার প্রচলিত ধারণাতে একটু মোচড় খায়, পাল্টে যায় শব্দার্থ খোঁজার দৃষ্টিকোণ। শব্দের দেহভিত্তিক প্রতীকী অর্থের বদলে আত্মাভিত্তিক ক্রিয়ানির্ভর অর্থ টেনে নিয়ে আসে ইতিহাস, ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ। কলিম খান ‘অ’ বর্ণটি বিশ্লেষণ করে দেখান যে এর ভেতরে কী পরিমাণ শক্তি রয়েছে। ‘অ’ থেকে অস্তিত্বন। তার আগে আছে বিন্দু (.) এবং অনুস্বার (s)। সমগ্র অস্তিত্বের শুরু বিন্দু থেকে।

বর্তমানে প্রচলিত সব ভাষায় শব্দের অর্থ নির্ণিত হয় প্রতীকীরূপে। কোনো একটি শব্দ কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুকে প্রতীকায়িত করে। ফলে একটা শব্দের একটা অর্থই দাঁড়ায়। কলিম খান বলেন এটা শব্দের বহিরঙ্গ। এর ভেতরে আরও কিছু রয়ে যায়। সেখানে যেতে হলে বাহিরের রূপে মজে না গেয়ে তাকাতে হবে শব্দের ভেতরে। যেতে হবে শব্দের আত্মার কাছাকাছি।

যেমন, প্রচলিত রীতিতে আম> mango কিন্তু কলিম খান দেখান আম শুধু একটি ফল নয়। আম এর সাথে জড়িয়ে আছে ‘অম’। এই ‘অম’ এর মূলে আছে ‘অ’, অ>অস্তিত্বন। ‘অ’ থেকে ‘অংরূপিনী’। ‘অংরূপিনী’ হলো একটি সক্রিয় আধার যা থেকে এই অখণ্ড জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। ‘আম’ এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ যা ঈষৎ পীড়িত করে। একে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সকল শক্তির আধার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হলো। এভাবে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির মাধ্যমে শব্দের প্রতীকী অর্থের দিকে না গিয়ে একটি ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী অর্থ বের করা সম্ভব যার মাধ্যমে শব্দের একবারে মূলে পৌঁছা যায় যেখানে একটি সক্রিয় শক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া এরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যেমে এক ভাষার শব্দের সাথে অপর ভাষার শব্দের যোগসূত্রও বের করা সম্ভব হয়। কলিম খান বিস্তারিত আলোচনা করে  দেখিয়েছেন industry এর সাথে কীভাবে ‘ইন্দ্রস্ত্রী’ এর সম্পর্ক রয়েছে production এর সাথে কীভাবে ‘পুরোডাশ’ এর সম্পর্ক আছে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে নেয়া যাক ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি আসলে কী বলতে চায়। উপরের আলোচনায় এ বিষয়ে কিছু ধারণা চলে এসেছে। তবু আরেকটু অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। এ বিধি বলে যে, শব্দের ভেতরেই শব্দের ‘মানে’ থাকে। এই মানেটাকে জেনে বাক্যের সাহায্যে সে কথা প্রকাশ করে দেয়া যায়। আর জগতের সকল কিছুর মূলেই আছে ক্রিয়া। অ(অস্তিত্বন) রক্ষার জন্য শক্তি দরকার, অর্থাৎ ‘ক্রিয়া’ সক্রিয় থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ ‘শব্দ’ শব্দটির কথাই ধরা যাক। প্রচলিত অভিধান মোতাবেক শব্দ = অর্থপূর্ণ ধ্বনি, রব, নিঃস্বন, নাদ। সবগুলো প্রতিশব্দ মিলে একটি শব্দ ‘শব্দ’কেই বুঝাচ্ছে। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি তা বলে না। এ বিধি বলে শব্দ>শব (সংঘাতশক্তির বাহক) দান করে যে (আওয়াজ)। ‘শ’ এবং ‘ব’ অক্ষর দুটো লক্ষনীয়। ‘শ’> (প্রাণশক্তিকে) বহন করে যে। আবার ‘ব’> বহন করে যে। অর্থাৎ প্রাণশক্তি বহন করে যে সে-ই তো আসলে শব্দ করতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বর্ণ আলাদা অর্থ প্রকাশ করছে। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি এভাবে প্রতিটি বর্ণের অর্থ প্রকাশ করতে সক্ষম। 

কলিম খান জানান ‘বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি ভারতীয় গ্রন্থাদির ভেতর মানবজাতির ইতিহাস অনুসন্ধান’ করতে গিয়ে তিনি প্রচলিত শব্দার্থবিধির অনুসরণ প্রক্রিয়ায় বাধার সম্মুখীন হন। তার অনুসন্ধানে তখন ধরা পড়ে যায় এমন এক পদ্ধতি যা অনুসরণ করলে এসব গ্রন্থাদি প্রাসঙ্গিকভাবে পাঠ করা যায়। এ থেকেই শুরু ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি’র চর্চা। ক্রমে সেই চর্চা নিজ ভাষার (বাংলা) ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শব্দের মূলে গমনের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার বিশেষত ইংরেজি ভাষার সাথে সামঞ্জস্যের একটি সূত্র উদঘাটন হয়। এ বিষয়ে লেখকের প্রথম রচনা ‘ভাষাতত্ত্বের পূর্ব দিগন্ত’ এ একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। পরবর্তী বিভিন্ন রচনায় এগুলোর মধ্যে কিছু শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়েছে। যেমন : অরণ্য> arena বর্বর> barbarian  বদ> bad ইত্যাদি। এ নিবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাচ্ছে না। আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক মূল বইসমূহ থেকে বিস্তারিত পাঠ নিতে পারবেন।

ইংরেজি ভাষার আদি উৎস খোঁজা হয় ল্যাটিন বা গ্রিকে। তেমনি বাংলা ভাষার আদি উৎস খোঁজা হয় সংস্কৃতে। পুরাণাদি তো সংস্কৃত ভাষাই রচিত। আবার সংস্কৃত নিজেই একটা সংস্কার করা ভাষা। কলিম খান সংস্কৃতের সাথে ল্যাটিনের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না এ নিয়েও ভেবেছেন। যদি কোনো যোগসূত্র থাকেই তাহলে এটা স্থাপিতই বা হলো কী করে? সংস্কৃত থেকে ল্যাটিনে নাকি ল্যাটিন থেকে সংস্কৃতে। এ এক দূরূহ বিষয়। এভাবে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাষাসমূহের এক আদি উৎস খোঁজার সূত্রের উন্মোচন করেন কলিম খান। এক্ষেত্রে তিনি সর্বাগ্রে নিজের দিকে অর্থাৎ প্রাচ্যের দিকে তাকিয়েছেন। সব অনুসন্ধানের ভিত্তি হিসেবে বাংলাভাষাকে রাখতেই তিনি ইচ্ছুক। বাংলাভাষার শব্দার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এক ‘পরম ভাষার সংকেত’ পাওয়া যেতেও পারে। বর্তমানে ভাষা সংকোচনের সময়ে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে তখন কলিম খানের প্রকল্পটি আশার আলো দেখাতে পারে।

পাশ্চাত্যের ভাষাতাত্ত্বিক চর্চার সাথে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির বেশ তফাৎ আছে। শুধু তফাৎ বললে অবশ্য বিষয়টি হালকা হয়ে যায়। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাচর্চার বিপরীতে বরং পাশ্চাত্যের ভাষাচর্চা বিভিন্ন দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। এ দুর্বলতার কারণ হলো ‘ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় শব্দার্থতত্ত্ব বা সিমেনটিক্স’ এর ব্যবহার। এর কারণে শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে শুধু এর বহিরঙ্গই দেখা যায়। এর ভেতরের দিকটা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ফলে ইংরেজিতে ass>ass, horse>horse. কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধির মাধেমে দেখানো যায় গাধা কেন ‘গাধা’, ঘোড়া কেন ‘ঘোড়া’।

পাশ্চাত্যের শব্দার্থতত্ত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে কলিম খান ও তার সহযোগী রবি চক্রবর্তী বলেন ‘সেই বিচারে শব্দার্থতত্ত্ব বিষয়ে তাদের অর্জ্জন শূন্য বললে কম বলা হয়।’ এর পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির মাধ্যমে যেভাবে শব্দের মর্মমূলে পৌঁছা যায় যায় এতে করে এ কথাকে একবারে অবান্তর বলে উড়িয়ে দেয়ারও উপায় নাই। বরং প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাবিদগণ শব্দের ভেতর থেকে শব্দের অর্থ বের করার রীতিই ব্যবহার করেছেন। এর শুরু ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে। অর্থাৎ এ অঞ্চল পাশ্চাত্য থেকেও এগিয়ে ছিল। কিন্তু পরে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শাসন এ শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়। তারা নিজেদের অনুসৃত পদ্ধতিকে এ অঞ্চলে চাপিয়ে দেয়। শব্দের প্রতীকী অর্থ বের করার জন্য তারা পদ্ধতি বাতলে দেয় যা উদারভাবে আমরা গ্রহণ করি, ঐতিহাসিকভাবে অনুসৃত পদ্ধতি ভুলে গিয়ে।

ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি ব্যবহার করলে দেখা যায় কেনো শব্দই ফেলনা নয়। প্রত্যেকটি বর্ণ একটি ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ধারণ করে। একটি শব্দের অর্থ বের করতে নামলে অনেকগুলো ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ চলে আসে। এর সাথে জড়িত হয়ে যায় এ অঞ্চলের ইতিহাস। বস্তুত পুরাণাদি পাঠ করতে গিয়েই যেহেতু কলিম খান এ বিষয়টি অনুধাবন করেন তাই পুরানে বর্ণিত বিষয়সমূহ কতোটা অর্থপূর্ণ, এগুলো আসলে কাল্পনিক নাকি কোনো বাস্তবভিত্তি রয়েছে তা-ও জানার প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্যের ‘সমাজের দেহ’ দেখা চোখ দিয়ে এ প্রচেষ্টা নেয়া সম্ভব নয়। তখনই নিজের দিকে ফিরে তাকানোর বিষয়টি এসে যায়। নিজের দিকে তাকোনো মানে ‘প্রাচ্য দেখে সমাজের মন’ এ চোখ দিয়ে তাকাতে হবে। অর্থাৎ শরীর ছেড়ে মনের দিকে যেতে হবে। ম্যাকআপ করা তথাকথিত সুন্দর মুখ আর উত্তাল দেহবল্লরীতে মজে গেলে অচেনা থেকে যাবে মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সম্পদ সমূহ। যা আদতে নিজেকে ভুলে যাওয়ারই নামান্তর।

এর মাধ্যম একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর নজর যেমন ছিল নিজের ভাষা বাংলার শব্দসমূহের মূলে পৌঁছা ও পাশ্চাত্যের দেখানো শব্দার্থ নির্ণয়ের কৃত্রিম পন্থাকে বর্জন করা। প্রাসঙ্গিকভাবে রবি চক্রবর্তীর একটি রচনার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায়—

এই যখন চারিদিকের অবস্থা, তখন নতুন পৃথিবী গড়ার নতুন কল্পনা, নতুন স্বপ্ন তুলে ধরার যে সাহস আমাদের হল, তার উৎস কোথায়? পৃথিবীর কোনো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাঙ্গনে কাজ করার সুযোগ আমাদের ঘটেনি। তবু এত বড় ভাবনা আমাদের মাথায় এল কী করে? কারণ খুব জটিল কিছু নয়। প্রাচীন ভারতের ভাষাতত্ত্বকে সাধ্যমত পুনরুদ্ধার ক’রে ও তাকে আজকের বিদ্যার সঙ্গে মিলিয়ে, পশ্চিমী ভাবনার ছক থেকে আমরা বার হয়ে এসেছি এবং আমরা ইতিহাস ও ঐতিহের উপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ বোধ করেছি। সমকালের মানবসভায় আমাদের বক্তব্য পেশ না করলে নিজেদের বিবেকের কাছে আমাদের ছুটি নেই। (ভাষাই পরম আলো)

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতীয় পুরাণাদি পাঠ করতে গিয়ে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সূত্রপাত হয়। প্রচলিত অভিধানগুলোর মাধ্যমে যখন এগুলোর অর্থ প্রকৃতরূপে উদ্ধার করা যাচ্ছিল না তখনই ভিন্নভাবে চিন্তা করা শুরু হয়। এ চিন্তা যত অগ্রগামী হয় ততই ধরা পড়ে পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের শব্দার্থ নির্ণয়ের পার্থক্য কতদূর।

কলিম খান তার ‘ভাষাতত্ত্বের পূর্বদিগন্ত’ প্রবন্ধে বলেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ‘অর্থ’ কথাটার মানে ‘জনপদঅধ্যুষিত ভূভাগ’। ইউরোপে যেতে যেতে ‘জনপদঅধ্যুষিত’ অংশটা বাদ পড়ে যায়, থেকে যায় কেবল ‘ভূভাগ’ অংশটা যা ইংরেজিতে পরিচিত ÔearthÕ হিসেবে। আবার অর্থ>মানে> money এটাও হয়। boat মানে কেন যে ‘নৌকা’ আর ‘goat’ মানে কেন যে ‘ছাগল’ তা ইংরেজিতে লেখা নাই। সংস্কৃত (মূলত সংস্কারকৃত ভাষা) হতে জাত বাংলা ভাষা থেকে এগুলোর অর্থ প্রকৃত অর্থোদ্ধার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলায় লেখা গ্রন্থগুলিকে ‘আত্মাভিত্তিক’ দৃষ্টিভঙ্গীতে অর্থাৎ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে লিখিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা গেল বাংলাভাষার শেকড় খুঁজতে নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানতে এ শব্দার্থবিধি অতীব প্রয়োজনীয়। 

তাই এ উপসংহারে আসা যায় যে, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি প্রকল্প পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। প্রাচ্যের যে নিজস্বতা আছে, আছে সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার তা পাশ্চাত্যের আধিপত্যের কাছে অনেকটা ম্রিয়মান হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানভাণ্ডারকে অতি অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে প্রাচ্যের ওপর। তাদের দেখানো পথে হাঁটতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন এ অঞ্চলের পণ্ডিতবর্গ। প্রাচ্য চিনে ‘আত্মা’ আর পাশ্চাত্য চিনে ‘দেহ’। পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু ‘দেহ’ দেখলেই আমরা ভুলে যাই তাহলে হারাব নিজেদের অতীত, ঐতিহ্য। আর যদি সচেতন হয়ে ‘আত্মা’ কে চেনার চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে এখান আছে অমূল্য রত্নভাণ্ডার। প্রাচ্যের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি’ প্রণয়ন করে কলিম খান একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজ করেছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যেহেতু কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ভাষা-দর্শন তূলনামূলক নতুন (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপাতত নমস্য স্থানে রেখে) তাই এ সম্পর্কে অনেক তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। তবে ভাষাতত্ত্বের জগতে এ নিয়ে যতো আলোচনা হবে এর গুরুত্ব ততই বাড়বে বলেই আশা করা যায়।


শামসুল কিবরিয়া কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। মূলত গল্প লেখেন, এর পাশাপাশি লেখেন সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : বৃত্তাবদ্ধ জীবনের প্রতিবিম্ব (২০১৯), কতিপয় স্মৃতির আর্তনাদ (২০২১)। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : বইকথা। তিনি সিলেটে বসবাস করেন।

menu
menu