।। দুটি কবিতা ।। মঈনুস সুলতান ।।

বালুঘড়ি

এদিকে চোখে তো পড়ে না তেমন কিছু—না বৃক্ষ না বনানী
গাড়ি হাঁকিয়ে পাথরের রুখা শুখা তেপান্তরটি পাড়ি দিতে গিয়ে
খেয়াল করি, ডিভাসের কোণে ভেসে ওঠছে ওয়াইফাই, 
সেরে ওঠেছো আশা করি—বার্তাটি মনে হচ্ছে অনুসন্ধানী,
লিংক যখন পেয়েছো—শুনে দেখো—শ্যামকল্যাণ রাগের সানাই।

না, জার্নি স্মুদ নয়—সামনে... বলা চলে বাধার বিপুল বিন্ধ্যাচল
পর্বতটির নাম যতোটা জানি—আদিবাসীদের ভাষায় হোপেন হুয়েন,
চাইলে সনাতন নামটি বদলে তুমি আজ হতে পারো সূর্যস্নাত স্বর্ণকমল
আমার তর্জমায় ভিয়েতনামের যে পদাবলীটি পাঠ করছো—
রচয়িতা এখনো বেঁচেবর্তে আছেন, তাঁর নামের উচ্চারণ হবে নগুয়েন;

সেরে উঠেছো তো… একটু ধৈর্য ধরতে হয় যে—
বালুঘড়ির কথা না হয় বলেই ফেলি,
প্রতি মুহূর্তে ঝরছে একটি… দুটি বালুকণা…
মরীচিকার অলীক সায়রে দিব্য রোশনি করছে সূর্যকেলি,
ম্রিয়মান হয়ে আসছে… পাঁজরের অতলে জমে আছে যে অনুশোচনা;

সময় কত হলো… ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করছি… কে জানে… কতক্ষণ?
মনে হয় পাড়ি দিয়েছি অজস্র ক্রোশ—অশেষ এ পর্বতে ওঠেছে চাঁদ,
পাথরের ছাউনিতে জোৎস্না-রাগে ঝংকৃত হচ্ছে… জীবাশ্মের বন—
সানাই একটু শুনেছো… বেশ তো… খুশি হয়েছি, 
এবার পাঠাও তো দেখি তোমার প্রিয় সেরেনাদ;

ঠিক ধরেছো… দৃশ্যপট বদলে গেছে পুরোপুরি—গিরিখাতটি ব্যাপক নিঝুম,
কিছু দূরে দূরে কারা যেন কুঁদে রেখেছে ক্রুশ,
সংগীতের যে প্রতিশব্দটি খুঁজছো ভিন্নভাষায়… তা হবে বোধ করি তারান্নুম—
আবহাওয়া খারাপ নয়—কবোষ্ণ বাতাসে সতেজ হয়ে ওঠছে ফুসফুস।

কলোরাডোর এ পর্বতমালা পাড়ি দিতে বোধ করি কেটে যাবে পুরো রাত
লিংক পাঠিয়েছো… সোনাটাটি না হয় শুনি… তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও—
পথ চিনতে সমস্যা হবে না—উপত্যকায় গড়িয়ে নামছে তিনটি প্রপাত,
ভিজ্যুয়েল ইমেজারির কিস্তিতে ভেসে ভেসে স্বপ্নে খানিক বৈঠা বাও;

গন্তব্য থাকবে না কেন?
প্রভাতে খুঁজে পাবো নেটিভ আমেরিকানদের উজাড় হওয়া জনপদ—
এদের দিনযাপন সম্পর্কে জানি কম—তবে দলিলপত্রে দেখেছি প্রতীক, 
শুকা-নদীটির তীরে নাকি ছড়িয়ে আছে চিত্রকল্পের অনিকেত এক অনুষদ,
এদিকে… বুঝলে… জীবন আর নেই তেমন—
পাষাণে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে কিছু উপাত্ত পুরাতাত্ত্বিক;

যদি পেয়ে যাই বিরান হওয়া রোদপাথরের জনপদ—
জাঁক করে বলা যাবে—মেরেছি বিরাট মতো এক দাও,
চাক্ষুষ করেছি নেটিভ আমেরিকানদের মন্ত্রণা সংসদ,
সড়কে নজর দিতে হয় যে… প্লিজ এবার একটু ঘুমাও—
না, আমাকে নিয়ে ভাবনার কিছু নেই… ভালো তো… সুপার কুল,
বিশ্রাম নাও… অফ করে দিতে দিতে ভাবছি—
                            রোগশয্যায় ফ্যানের বাতাসে উড়ন্ত এলোচুল…।

 
কোপার্নিকাসের নামাঙ্কিত খাদ

ধারালো খঞ্জরে পার্চমেন্টে খঁচা পাণ্ডুলিপিটি
হাজার বছরে বুঝিবা হয়েছে পুরাতাত্ত্বিক,
তর্পণ করেছি তরজমা—নিরিখ করেছি প্রতিটি হরফ
আঁকজোকের নকশা আদতে কীসের প্রতীক—
মর্মার্থ পারিনি বুঝতে,
অতিক্রান্ত দ্বিপ্রহর গড়িয়েছে গোধূলিতে
কেটেছে বেলা রকমারি পাথর খুঁজতে, 
অতিক্রম করেছে বিষুবরেখা পরিব্রাজক পাখি তীব্র শীতে।

মাঝেমধ্যে দিয়েছি মনযোগ সংখ্যাতত্ত্বে!
মিলাতে পারিনি হিসাব,
গ্রহান্তর থেকে বুঝিবা কেউ পাঠিয়েছে গুপ্ত সংকেত—
প্রজাপতির ডানা ছড়িয়েছে বর্ণিল খোয়াব,
তা সত্ত্বেও!
মনে হয়েছে—পঙ্গপালের ফসলবিনাশী উড্ডয়নে
বিরান হলো আমার সুফলা ক্ষেত;

পেয়ালা উপচানো জলে মিটেনি তিয়াস—
জানতে চেয়েছি নদনদীর গতিবিধি,
বেনোজলে ভেসেছে নীড়...শাবকের মুখে মা-পাখি 
তুলে দিয়েছে ডানাকানার আহার,
মনের মন্দিরে মন্দ্রিত হয়েছে এ ছবি মধুহৃদি—
বহতা জলে ফুটেছে হায়াসিন্থের বর্ণবাহার;

জোৎস্নায় আলোয়ানে জড়িয়ে গতর 
চাইনি যেতে তারকার মাইফেলে—
বুঝতে চেয়েছি ঠিক ক’ক্রোশ দূরে চাঁদ,
কেটে তো যাচ্ছে দিবানিশি দিব্যি হেসেখেলে—
নির্জনতার পূর্ণিমারিক্ত আঁধারে এ বেলা 
উজালা হয়েছে কী কোপার্নিকাসের নামাঙ্কিত খাদ।


মঈনুস সুলতান কবি, গল্পকার ও ভ্রামণিক। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কবিতা ও গল্প লিখছেন। হালফিল লিখেছেন কিছু ভ্রমণ-ভিত্তিক আলেখ্য। প্রাচীন মুদ্রা, সূঁচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরোনো দিনের মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।

menu
menu