আই ইভেন মেট হ্যাপি জিপসিস, ১৯৬৭

আজ আমরা কথা বলব এমন একটি চলচ্চিত্র নিয়ে, যা গত দেড়যুগ ধরে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে রয়েছে। বলা যায়, ২০০৮ সালে বিশ্ব-চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার দারুণ আগ্রহ তৈরিই হয়েছিল এ চলচ্চিত্রটি দেখার মাধ্যমে। আমরা কথা বলছি আলেকজান্দার পেত্রোভিচ পরিচালিত আই ইভেন মেট হ্যাপি জিপসিস—এই য়ুগোস্লাভ চলচ্চিত্রটি নিয়ে। চলচ্চিত্রটির মূল নাম Skupljaci Perja, যার অর্থ ‘পালক সংগ্রাহক’। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি কেবল য়ুগোস্লাভিয়ার নয়, বরং বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এটি ১৯৬৭ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়ন লাভ করে, এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে গ্র্যান্ড জুরি ও ফিপ্রেসি পুরস্কার জিতে নেয়।
পেত্রোভিচ য়ুগোস্লাভ চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রভাবশালী পরিচালক। তিনি প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রাগের বিখ্যাত একাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টসে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে পড়াশোনা করেন। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি, পরে বেলগ্রেডে আর্ট হিস্ট্রিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন, এবং তার প্রথম দিকের ডকুমেন্টরিগুলো সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। এর আগের বছর তার নির্মিত ট্রি চলচ্চিত্রটি অস্কারে মনোনয়ন লাভ করলেও মূলত এই চলচ্চিত্রটিই তাকে আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দেয়। এটি মুক্তি পেয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন য়ুগোস্লাভ চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাক ওয়েভ’ নামে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই আন্দোলন ছিল সামাজিক বাস্তবতাকে নির্মমভাবে উপস্থাপন করার এক ধরনের প্রতিবাদী ঢেউ, যেখানে শিল্পীরা দারিদ্র্য, নিপীড়ন ও নৈতিক জটিলতা প্রকাশ করতে সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। পেত্রোভিচ ছিলেন এই ধারার অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি, আর এই চলচ্চিত্র সেই আন্দোলনের অংশ, যা ৬০-এর দশকে য়ুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
এই চলচ্চিত্রে তিনি রোমা সম্প্রদায়ের জীবনকে একটি নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন, তবে রোমান্টিকতার ফাঁদ এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এমন চলচ্চিত্রে বিশ্বাস করি না, যা তথাকথিত “বার্তা” দেয়; আমার এই চলচ্চিত্রটি ভোজভোদিনার রোমাদের জীবনের একটি সরল অংশ।’ মূলত, এটি ছিল প্রথম চলচ্চিত্র, যেখানে রোমারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলেছিল—যা তখনকার সময়ে ছিল সাহসী এক পদক্ষেপ। পেত্রোভিচ জানতেন—ভাষার বিশুদ্ধতা মানেই সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্র বোরা—একজন পালক ব্যবসায়ী। স্বভাবে কমনীয়, তবে উদ্ধত ও নির্দয়। সে তার চেয়ে বয়স্ক এক নারীর সঙ্গে বিবাহিত, কিন্তু কিশোরী তিশার প্রতি আকৃষ্ট—যাকে তার সৎ বাবা জোর করে অপ্রাপ্তবয়স্ক এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। তিশা সেই বিয়ে প্রত্যাখ্যান করে বোরার সঙ্গে পালিয়ে যায়। তাদের প্রেমকাহিনি সহিংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং দুঃখে ভরা। শেষে বোরা তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী মির্তাকে হত্যা করে পালায়, আর তিসা ধর্ষণের শিকার হয়ে গ্রামে ফিরে আসে। চলচ্চিত্রটির নামকরণ যেন দারুণ বিদ্রূপাত্মক, কারণ এখানে সুখী জিপসির সঙ্গে দেখা হবার কথা বলা হলেও আদতে কোনো সুখী জিপসি নেই, বরং এখানে তুলে ধরা হয়েছে রোমা সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য, সহিংসতা, এবং পিতৃতান্ত্রিক শোষণের নির্মম চিত্র।
বলতে গেলে এর চিত্রনাট্য ছিল নিতান্তই সাদামাটা, কিন্তু চিত্রায়ন ছিল এক কথায় অসাধারণ। টমিস্লাভ পিন্টারের ক্যামেরায় তুলে ধরা ভোজভোদিনা গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং রোমা জীবনের কঠোর বাস্তবতার অসাধারণ চিত্রায়ন পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই আমাদের সামনে বারবার উঠে এসেছে। চলচ্চিত্রের প্রতিটি
ফ্রেমই যেন একেকটি ভাস্কর্য—কর্দমাক্ত গ্রাম, যেখানে সেখানে হাঁসের পাল, ভাঙা-চোরা ঘর-বাড়ি, ঝাপসা আলো ও মানুষের মুখ—সবই বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে সুচারুভাবে ফ্রেমবন্দী করা হয়েছে। বিশেষ করে মুখ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ক্লোজশটে নেওয়া একেকটি ফ্রেম মনের গভীরে এমনভাবে ছাপ ফেলে যে—মানুষের মুখ নতুন করে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। এছাড়া চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভোজভোদিনার রোমা গান, বিশেষ করে জেলেম জেলেম গানটি, যা এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, এবং পরে রোমাদের আন্তর্জাতিক সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। গানটি অলিভেরা ভুচোর কণ্ঠে দারুণ আবেগপূর্ণভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি রোমা সম্প্রদায়ের প্রতি পশ্চিমা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে। সমালোচকরা এটিকে ‘জিপসি মিথ’-এর একটি নৃতাত্ত্বিক দলিল হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা রোমাদের জীবনকে রোমান্টিক বা বহিরাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পরিবর্তে, তাদের সংগ্রাম এবং বাস্তবতার ওপর জোর দেয়। এছাড়া এটি রোমা নারীদের ওপর পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নের ওপরও আলোকপাত করে। তিশার চরিত্রটি তার শরীর এবং পছন্দের উপর সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি তৎকালীন ইউগোস্লাভ সমাজে নারী ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অবস্থান নিয়ে আমাদের দিকে দারুণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
চলচ্চিত্রটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক—কলাকুশলীদের অভিনয়। বিশেষত প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা ‘বেকিম ফেহমিউ’-এর অভিনয়—আজীবন স্মরণ রাখার মতো। তাকে পর্দায় দেখতে দেখতে এক দক্ষিণ কোরিয়ান অভিনেতার কথা বারবার মনে পড়ছিল। পর্দায় ফেহমিউ-এর সার্বিক উপস্থিতির সাথে হোয়াং জং-মিন-এর এতোটাই মিল যে, যদি বলা হয় জং-মিন এই অভিনেতাকে অনুসরণ করেন, তবে বাড়িয়ে বলা হবে না। ফেহমিউ বোরা চরিত্রটিতে এতোটাই সাবলীল ছিলেন যে, দর্শক হিসেবে আমাদের মনে হতে বাধ্য—এই চরিত্রের জন্য কেবল তিনিই পারফেক্ট। বিশেষ করে বোরার চরিত্রে একই সঙ্গে কমনীয় এবং নির্দয় অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার অসম্ভব কাজটি তিনি যথার্থভাবেই করছেন।
অন্যদিকে অপর প্রধান চরিত্র তিশা আর তাতে রূপদানকারী ‘গোর্দানা জোভানোভিচ’ ছিলেন একজন অপেশাদার অভিনেত্রী। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। তিনি ভোজভোদিনা অঞ্চলের একটি প্রান্তিক রোমা সম্প্রদায়ে বেড়ে উঠেছিলেন এবং পালক সংগ্রহের কাজ করতেন। পরিচালক পেত্রোভিচ তাকে এই চরিত্রের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য, নির্ভীকতা এবং কাঁচা আবেগের কারণে, যা সেই চরিত্রের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর জোভানোভিচ অপেশাদার হওয়া সত্ত্বেও আক্ষরিক অর্থেই এই চরিত্রটির সঙ্গে সুবিচার করেছেন। শুধু যে জোনানোভিচই যে এই চলচ্চিত্রের অপেশাদার শিল্পী ছিলেন তা নয়, বরং এতে অনেক প্রকৃত রোমারাও ছিলেন, যারা তাদের নিজস্ব জীবনের বাস্তব প্রতিফলন খুব দারুণভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
আই ইভেন মেট হ্যাপি জিপসিস কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিবৃতি। পেত্রোভিচের দূরদৃষ্টি, কলাকুশলীদের শক্তিশালী ও বাস্তবধর্মী অভিনয়, এবং রোমা সম্প্রদায়ের প্রতি তার সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি—এটিকে কালজয়ী করে তুলেছে। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র—যা বিস্ময়, অস্বস্তি, এবং গভীর চিন্তার জন্ম দেয়। বালকান চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি এক মাইলফলক এবং ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
যারা চলচ্চিত্রে বিনোদনের বাইরে জীবন ও বাস্তবতার গভীর প্রতিফলন দেখতে চান, তাদের জন্য এটি অবশ্যই দেখার মতো এক চলচ্চিত্র, যা দর্শক হিসেবে আপনাকে নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করবে, এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। বস্তুত, এটি কোনো কল্পনার উপাখ্যান নয়, এটি বাস্তবতার এক বিষণ্ন প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের এমন এক জগতে টেনে নিয়ে যান, যেখানে মানুষ বাঁচে, ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে—কিন্তু বঞ্চিত হয় ন্যায্য সম্মান ও অধিকার থেকে।
অরণ্য কবি। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন।