দুটি অণুগল্প

তাপসী

গাড়ির ওয়েল চেইঞ্জ করতে চেরিহিল রোড ধরে কলেজ পার্ক যাই প্রতি তিন মাসে একবার। পথে ‘বাংলা বাজার’ নামে একটা স্বদেশী গ্রোসারি সপে স্টপ বাই করি। 
একদিন সেই গ্রোসারি সপে তাপসীর সঙ্গে দেখা। নাম যেমন সুন্দর দেখতেও তেমন সুন্দর। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাই। প্রস্তাব করতেই রাজি হয়ে যায়। কেন যে অল্পতেই প্রেমে পড়ে যাই।
তাপসীকে নিয়ে ‘কৃষ্ণ আইল রাঁধার কুঞ্জে, ফুলে পাইলা ভ্রমরা’ গাইতে গাইতে বাড়িতে ফিরে আসি। বাড়িতে ঢুকতেই তাপসীর গায়ের রং চাঁদের আলোর মতো চিকচিক করতে থাকে। 
তাপসীকে দেখেই গিন্নির মাথায় আগুন ধরে যায়। মাথার আগুনে জ্বলে উঠে চুলার আগুন। তৎক্ষণাৎ গিন্নি তাপসীকে ধুয়ে মুছে গরম তেলের কড়াইতে বসিয়ে দেয়। তাপসী ভাজি হতে থাকে চুলায় আর আমি সিদ্ধ হতে থাকি পরকীয়ার যন্ত্রণায়।
আধ ঘণ্টা পর তাপসী চলে আসে খাবার টেবিলে। প্লেট ভর্তি গরম ভাতের ওপর তাপসী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। পেট ফুলে আছে। হয়তো প্রেগন্যান্ট ছিল। গায়ের রুপালি রং বদলে হলদে আকার ধারণ করেছে। এ কি কষ্টের রং, নাকি আনন্দের?
আর কত সহ্য হয়! পেটে তখন রাজ্যের ক্ষুধা। নিমিষেই পেটের গহ্বরে বিলীন হয়ে যায় তাপসী।
ভুরিভোজ শেষে গেয়ে উঠি…
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান!

 
ও পাখি তোর যন্ত্রণা ও আত্মসম্মানবোধ

গত দুই দিন যাবৎ বাড়ির ভেতরে অবিরাম ঠক ঠক শব্দ শুনিতেছি। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে আবার শুরু হয়। এই রকম ভৌতিক শব্দের উৎস খুঁজিতে যাইয়া একেবারে পেরেশান হইয়া উঠিয়াছি। অনেক পর উপলব্ধি করিলাম যে ছেলের ঘর হইতে এই খোঁজাখুঁজির গায়েরি শব্দ আসিতেছে। কিন্তু ছেলের ঘরে ভেতরে গিয়া কোথায়ও কিছু দেখিলাম না। ভাবিলাম পাশের বাড়ি হইতে দেয়ালে পেরেক মারিবার শব্দ হইতেছে। বউ ভেংচি মারিয়া কহিল, ‘তাহারা গত দুইদিন ধরিয়াই দেয়ালে পেরেক মারিতেছে নাকি? বরং বাড়ির মাচায় (Attic) উঠিয়া দেখ, কোন ভূতটুত মাচায় বাসা বাঁধিয়াছে কিনা।’ আল্লাহ খোদার নাম লইয়া মাচায় উঠিলাম। কিন্তু কোন ভূতের দেখা না পাইয়া হতাশ হইয়া নিচে নামিয়া আসিলাম। 
অবশেষে কী মনে করিয়া বাড়ির বাহিরে আসিলাম এবং দেখিলাম, এক রূপসী কাঠ ঠোকরা (Woodpecker) জানালার ওপরের ওয়ালে লটকাইয়া বাড়ির কাঠের চৌকাঠে ঠোঁট দিয়া অবিরাম ঠোকর মারিতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া হতভম্ব হইয়া গেলাম। চারিদিকে এত সবুজ গাছগাছালি আর বড় বড় অট্টালিকা থাকিতে আমার এই গরিব বাড়ির চৌকাঠে কি মধু পাইল এই অবুঝ পাখি, তাহা মাথায় ঢুকিতেছে না। তাড়াতাড়ি বউকে ডাকিয়া কহিলাম, ‘ওগো, দেখিয়া যাও, গায়েবি শব্দের উৎস আবিষ্কার করিয়াছি।’ 
বউ ছবি তুলিতে তুলিতে গান ধরিল...।
ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয় না।
যখন তখন করে জ্বালাতন ভালো লাগে না।
আমি নিচে দাঁড়াইয়া একখান ছোট্ট গাছের ডাল পাখিটার দিকে ছুঁড়িয়া মারিলাম। পাখিটার গায়ে লাগিল না। তবে পাখিটা ভয় পাইয়া পাশের বড় গাছের পাতার ভেতরে হারাইয়া গেল। আমিও আপদ চলিয়া গেল ভাবিয়া বাড়িতে আসিয়া বেডরুমে শুইতে গেলাম। চোখে ঘুম আসিতেই আবার ঠক ঠক শব্দ। পুনরায় বাহিরে আসিয়া দেখি সেই একই কাণ্ড। একবার চিন্তা করিলাম, চোর ডাকাতের জন্য নাইন ওয়ান ওয়ান কল করা যায়, কিন্তু এই অবুঝ পাখির জন্য কাকে কল করিব। কোন কূল কিনারা না-পাইয়া মেজাজ খারাপ করিয়া পাখিটার দিকে একখান ছেঁড়া জুতা ছুঁড়িয়া মারিলাম। এইবারও পাখিটার গায়ে লাগিল না। তবে পাখিটা ভয়ে পালাইয়া গেল। আমিও বাড়ির ভেতরে আসিয়া অপেক্ষায় রইলাম আবার ঠক ঠক শব্দ শুনিবার। কিন্তু না, আর শব্দ হইল না। পরদিনও হইল না। 
আহা! ছেঁড়া জুতার কি মহিমা! 
তবে এইটাও বুঝিলাম, পাখিরও আত্মসম্মানবোধ আছে বটে। 


মিজানুর রহমান খান নাট্যকর্মী ও কবি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড রাজ্যের ওলনি শহরে বসবাস করেন।

menu
menu