বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে ভাষাতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ


ভ্রমণ কাহিনি একটি জনপ্রিয় সাহিত্য প্রকরণ। কাহিনিকারের পর্যবেক্ষণ, চিন্তন, দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ভ্রমণ বৃত্তান্ত গড়ে উঠলেও তা সাহিত্যে পরিণত হয় লেখকের সৃষ্টি ক্ষমতার জোরে। বাংলা সাহিত্যের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ক্ষেত্র ভ্রমণ কাহিনি; যেখানে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় এমন কিছু দৃষ্টান্ত যা হয়ে ওঠে সমাজ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সাংবাদিকতার জগতে ইদানীং একটি টার্ম বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে; তা হলো ‘স্লো জার্নালিজম’; স্বভাবগতভাবে ব্রেকিং নিউজের একেবারে বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছে এই ধারণাটি। ‘স্লো জার্নালিজম’ হলো এক জাতীয় মগ্ন সাংবাদিকতা যা সাংবাদিককে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে থেকে সেখানকার জনজীবন অত্যন্ত গভীরভাবে দেখতে ও বুঝতে প্রণোদিত করে। ভ্রমণ সাহিত্যিকও একইরকমভাবে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষা প্রয়োগ লক্ষ করেন এবং সেটি লিপিবদ্ধ করে রাখেন ভ্রমণ কাহিনির পরিসরে। সে ক্ষেত্রে ভ্রমণ কাহিনিতেও স্বাভাবিকভাবেই এসেছে এমন কিছু ভাষিক প্রসঙ্গ যা ভাষাতত্ত্ব বা ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত তিনটি টেক্সটের সাপেক্ষে আলোচ্য আলোচনাটি গ্রন্থিত হয়েছে। প্রথম দুটি রচনা নারায়ণ সান্যালের লেখা এবং তৃতীয় রচনাটি তারাপদ রায় লিখিত।

নারায়ণ সান্যালের লেখা ভ্রমণ কাহিনি দণ্ডক শবরী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। গ্রন্থের নামকরণের আড়ালেই কাহিনির পটভূমি ব্যঞ্জিত হয়েছে। এই কাহিনির প্রেক্ষাপট সুপ্রাচীন ভারত সংস্কৃতির লীলাভূমি দণ্ডকারণ্য; যা বর্তমানে দেশের কয়েকটি রাজ্যের বেশ কিছু জেলা জুড়ে অবস্থান করছে। হাতে আঁকা দণ্ডকারণ্যের একটি নট টু স্কেল মানচিত্র লেখক বইয়ের সূচনায় সংযোজিত করেছেন। দণ্ডকারণ্যে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগুলোর মধ্যে তিনটি জাতির প্রকৃতি সবচেয়ে আদিম। এই তিনটি জাতি হলো অবুঝমাড় পাহাড়ে বসবাসকারী অবুঝমাড়িয়া, গঞ্জাম জেলায় অবস্থানকারী শবর, আর মালকানগিরি অঞ্চলের বাসিন্দা বোণ্ডো। এর মধ্যে বোণ্ডোদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। বোণ্ডোর সঙ্গে ধ্বনিগত সাদৃশ্য রয়েছে গোণ্ডর। দণ্ডকারণ্যে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী গোণ্ড। গোণ্ড ভাষা দ্রাবিড় ভাষা বংশজাত; তবে বোণ্ডো পৃথক ভাষা বংশজাত। অস্ট্রিক ভাষা বংশের অস্ট্রো এশিয়াটিক শাখাটি ভারতে প্রচলিত। অস্ট্রো এশিয়াটিক শাখার তিনটি শ্রেণি হলো মুণ্ডা বা কোল, খাসি নিকোবরী ও মোন-খমের। মুণ্ডা বা কোল শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা হলো বোণ্ডো। এই বোণ্ডো ভাষার অপর নাম রেমো।

বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম ওড়িশার মালকানগিরি জেলার খাইরপুট ব্লকের তিরিশটি গ্রামে বোণ্ডোদের বসবাস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোণ্ডো ভাষা বর্তমানে ‘বিপন্ন ভাষা’ বা ‘এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে চিহ্নিত। ভাষা গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রণী প্রতিষ্ঠান ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস’। বিপন্ন ভাষা রক্ষার্থে উক্ত প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্প হলো ‘স্কিম ফর প্রোটেকশন এন্ড প্রিজারভেশন অফ এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজেস’; যে প্রকল্পের মাধ্যমে বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণের একটি প্রয়াস চলছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বোণ্ডো জাতির জনসংখ্যা ১২,৩৩১। বোণ্ডো ভাষাভাষীরা জীবিকার তাগিদে বর্তমানে বহির্জগতে পদার্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলত তৈরি হয়েছে দ্বিভাষিকতার পরিসর। এই কারণে অন্যান্য ভাষার ভাষিক উপাদানের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে বোণ্ডো ভাষায়। বোণ্ডো জাতির বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ওড়িয়া, সে কারণে ওড়িয়া ভাষার ধ্বনিগত ও রূপগত প্রভাব পড়েছে বোণ্ডো ভাষায়।

আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে নারায়ণ সান্যাল সংগ্রহ করেছিলেন বোণ্ডো ভাষার কিছু শব্দ; মূলত সম্পর্কসূচক বা আত্মীয়তাবাচক কিছু শব্দ তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে উল্লেখ করেছেন; যেমন : দাদা ˃ মাঙ্‌, দিদি ˃ মিঙ্, বোন ˃ কু, জ্যাঠা ˃ বুমান, শ্বশুর ˃ আঙকুই ইত্যাদি। গ্রন্থের পরিসরে লেখক জানাচ্ছেন, এমনকি এমন যে সম্পর্ক ‘মা’—যার অভিধা প্রায় সারা বিশ্বে ‘ম’ অক্ষর যুক্ত—তাকে বলে ‘য়ুং’; অর্থাৎ অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোষ্ঠীর ভাষাগুলোতে মা বাচক শব্দ কিন্তু সাধারণভাবে ‘ম’ বর্ণ দিয়ে শুরু হচ্ছে না। এই গোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা সাঁওতালিতে যেমন ‘মা’ বাচক শব্দটি হল ‘আয়ো’ বা ‘এংগা’। আবার যে ভাষাটি বোণ্ডোর সঙ্গে সবচেয়ে নিকট সম্পর্কযুক্ত, সেই ‘গুটব’ বা ‘পেড়ো গাড়োয়া’ ভাষায় ‘মা’ হলো ‘জেন’। তবে এখানে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে বিষয়টি লেখককেও যা চূড়ান্ত বিস্মিত করে তুলেছিল, তা কোনো মাতৃবাচক শব্দ নয়; শব্দটি হলো ‘মহাপ্রভু’।

আজ থেকে ষাট বছর আগে যখন বোণ্ডোদের গতিবিধি মূলত নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একটি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার সততই আশ্চর্যজনক। এর প্রেক্ষিতে লেখক অনুমান করেছেন দণ্ডকারণ্যের এই প্রত্যন্ত বোণ্ডো গ্রামে শ্রীচৈতন্যের পদচারণাই হয়তো বোণ্ডোদের ভাষায় এই শব্দভুক্তির কারণ। এর পাশাপাশি যে শব্দটি বোণ্ডো ভাষায় প্রচলিত তা হলো ‘মহাপ্রসাদ’। ‘মহাপ্রসাদ’ শব্দটি তারা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে থাকে। এই প্রসঙ্গটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ; বাঙালি সমাজে তথা বাংলা সাহিত্যে সই পাতানোর যে একটি ঐতিহ্য লক্ষ করা যায়, এটি হলো সেই বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। বোণ্ডো সমাজে বন্ধুত্বের পরিচায়ক ‘মহাপ্রসাদ’। লেখক দণ্ডকারণ্যের অসংখ্য উপজাতির সংস্পর্শে এসেছিলেন; কিন্তু তিনি নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছিলেন বোণ্ডো জাতির ভাষা। আশ্চর্যজনকভাবে ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস’ যে বারোটি বিপন্ন ভাষার অভিধান তৈরি করেছে, তার মধ্যে একটি হলো বোণ্ডো। হয়তো লেখক সেই সময়েই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বোণ্ডো ভাষার বিপন্নতা, অনুভব করেছিলেন তা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা।

প্রাথমিকভাবে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম; বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সংযোগ সাধন সম্ভব হয় ভাষার মাধ্যমে। এই যোগাযোগ বা সংযোগের সূত্রেই যে প্রসঙ্গটি চলে আসে তা হলো সাংকেতিক ভাষা বা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার হয়ে থাকে। চর্যা গানে ব্যবহৃত সন্ধ্যাভাষা থেকে গ্রাম বাংলার কিশোর-কিশোরী মহলে প্রচলিত ‘ট-ভাষা’ পর্যন্ত তার অপার বিস্তার। নারায়ণ সান্যাল তাঁর পয়োমুখম গ্রন্থে সাংকেতিক ভাষা বা কোড ল্যাঙ্গুয়েজের অপূর্ব দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তবে এক্ষেত্রে সংকেত ভাষা লোক ঠকানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

পয়োমুখম গ্রন্থে উল্লিখিত ভ্রমণের গন্তব্যস্থল ছিল কুম্ভ মেলা। কুণ্ডু স্পেশালের তত্ত্বাবধানে লেখক রওনা দিলেন কুম্ভ মেলার উদ্দেশ্যে; অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে এসে উঠলেন হরিদ্বারের এক হোটেলে। সহযাত্রীদের কাছেই তিনি একদিন খবর পান নদীর ওপারে এক সাধু নাকি যোগ শক্তি বলে মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ সব বলে দিচ্ছেন অলৌকিক উপায়ে! সাধু বাবাজির নামটিও বেশ অদ্ভুত! অ্যাটম বাবা! এহেন নামকরণের কারণ কী? লেখক জানিয়েছেন, তিনি নাকি যৌগিক প্রক্রিয়ায় পরমাণুর অন্তর বিদীর্ণ করতে সক্ষম। আর তাঁর এই মহান কর্মযজ্ঞের উদ্দেশ্যটিও ততোধিক মহান; সেটি হলো মহৎ কুম্ভ স্নানের আগে যাবতীয় পার্থিব চিত্তচাঞ্চল্য থেকে মনকে মুক্ত করা!

বিজ্ঞানের স্নাতক এক মহিলা সহযাত্রীর কাছে লেখক শোনেন একটি তাঁবুর মধ্যে অ্যাটম বাবার থেকে প্রায় কুড়ি ফুট দূরে অবস্থান করছেন তাঁর সহকারী যিনি টিকিট কাটার দায়িত্বপ্রাপ্ত; যে সাধু টিকিট কাটছেন, দর্শনার্থীরা তাঁর কাছে গিয়ে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে তাঁরই কানে কানে জাগতিক সমস্যার বিবরণ দিচ্ছেন হিন্দি ভাষায় অত্যন্ত নিম্নস্বরে; ওই সাধু দর্শনার্থীর সমস্যাটি শুনে একটি সাদা কাগজে দুর্বোধ্য ভাষায় তা লিখে কাগজটি ভাঁজ করে ওই দর্শনার্থীকে দিয়েই তা পাঠিয়ে দিচ্ছেন অ্যাটম বাবার কাছে; দর্শনার্থী কাগজটি ডান হাতে মুঠো করে ধরে রাখছেন; বাঁ হাতের রেখা দেখে অ্যাটম বাবা তার জাগতিক সমস্যার সমাধান বাতলে দিচ্ছেন; অর্থাৎ সেই হিসেবে অ্যাটম বাবা দর্শনার্থীর প্রশ্ন বা সমস্যা কিছু না জেনেই ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে চলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই দর্শনার্থীদের কাছে এটি অত্যাশ্চর্য ও অলৌকিক বিষয় হিসেবে প্রতিভাত হয়। বাবাজীর অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসংশয় দর্শনার্থীরা তাঁর নির্দেশিত মাদুলি, তাবিজ ক্রয় করতে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তবে এখানে যে ঘটনাটি না জানলেই নয়, সেটি হল ওই টিকিট বিক্রেতা সাধুর পাশে বসে অন্য একজন সাধু কোন একটি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় সুর করে মাইক্রোফোনে অবিরাম মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন।

রহস্য সমাধানে পরদিন সকালেই অ্যাটম বাবা সমীপে পৌঁছে যান লেখক। পূর্বশ্রুত ঘটনাবৃত্ত মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রথমে লেখক লক্ষ করেন কোন মেসেঞ্জার পিয়ন বা কুরিয়ার সার্ভিস অলক্ষ্যে বার্তা প্রেরণের কাজটি করছে কিনা! কিন্তু তিনি তেমন কিছু খুঁজে পান না; তাঁবুতে নেই কোন ওয়াকি-টকি, শর্ট-সার্কিট ট্রান্সমিটার বা টিভি জাতীয় কোন যন্ত্র; বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করেও যখন তিনি রহস্য সমাধানে অপারগ থাকেন, তখন হঠাৎ তাঁর পাঞ্জাবিতে একটা হেঁচকা টান পড়ে। তাঁকে ডেকে তাঁবুর বাইরে নিয়ে যান এক ব্যক্তি, পেশাগতভাবে যিনি ব্যাঙ্গালোরের একটি কলেজের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক।

তিনি লেখককে অ্যাটম বাবার অসাধু কৌশলটি সরল ভাবে বুঝিয়ে দেন : যে সাধু মন্ত্র পাঠ করছেন, তিনি আসলে কন্নড় ভাষায় একটি ধর্ম পুস্তক সামনে রেখে রামচরিতমানসের সুরে আবৃত্তি করছেন। কিন্তু উনি ওই ধর্ম পুস্তকের পাতাগুলোর কেবল উল্টোচ্ছেন, পাঠ করছেন না। তিনি কন্নড় ভাষাকে বেস ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে রেখে একটি কোড ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করেছেন; ‘বি’ ধ্বনি উচ্চারণ করছেন ‘সি’ এবং ‘সি’ ধ্বনি উচ্চারণ করছেন ‘বি’ রূপে। এইভাবে দর্শনার্থীদের প্রদত্ত প্রশ্ন ওই কোড ল্যাঙ্গুয়েজে এনকোডেড হয়ে মাইক্রোফোনে পঠিত হচ্ছে। মাইকে ঘোষিত সেই এনকোডেড বার্তা অ্যাটম বাবা ডিকোড করে তাঁর কার্য সমাধা করছেন, ভক্ত উত্তরপ্রার্থীকে নির্দিষ্ট নির্দেশ প্রদান করে কৃতার্থ করছেন; এভাবে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হচ্ছে। ঠিক যেভাবে বাংলায় ‘ট’ ভাষা ব্যবহৃত হয়; লেখক উদাহরণ দিয়েছেন ‘চি’ ভাষার; শব্দকে ভেঙে প্রত্যেক শব্দাংশের আগে ‘চি’ যোগ করে যা প্রয়োগ করা হতো: ‘চিতু চিমি চিক্যা চিমন চিআ চিছ?’ অর্থাৎ ‘তুমি কেমন আছো?’; সংকেত ভাষা বা কোড ল্যাঙ্গুয়েজের প্রায়োগিক দৃষ্টান্তের একটি অনন্য উদাহরণ অ্যাটম বাবা।

স্থান-কাল ভেদে শব্দার্থের বদল ঘটে যায়। একই শব্দের অর্থ ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে ভিন্ন অর্থ বহন করে। স্থানভেদে শব্দার্থের পরিবর্তনের এই ধারাটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ব্রিটিশ ইংরেজি ও আমেরিকান ইংরেজির ক্ষেত্রে। ভারতে যে ইংরেজি ছোট থেকে শেখানো হয়, তা মূলত ব্রিটিশ ইংরেজির আদলে তৈরি। এরূপ ব্রিটিশ ইংরেজি শিখে আমেরিকায় তা প্রয়োগের পরিণতি যে কী পরিমাণ উদ্ভট হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে তারাপদ রায়ের নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক গ্রন্থে।

রম্যরচনাকার হিসেবে তারাপদ রায় ভীষণ জনপ্রিয়। লেখকের আমেরিকা ভ্রমণের ইতিবৃত্ত এই গ্রন্থটি। ১৯৭৮ সালে জানুয়ারিতে ‘কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে’ তারাপদ রায় আমেরিকা যান। ঘটনাটি ঘটে নিউ ইয়র্কের রাস্তায়; শীতের দিনে ভীষণ ঠান্ডায় লেখক একটি মাফলারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। লেক্সিংটন এভিনিউ নামের ওই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর চোখে পড়ে একটি দোকান, শোকেসে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন বস্ত্র সম্ভার; কয়েকটা মাফলার তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়; কাচের বাইরে থেকে দেখে একটা রামধনু রঙের মাফলার তিনি পছন্দও করে ফেলেন; সাহসে ভর করে এরপর ঢুকে যান দোকানে; একজন অল্প বয়স্কা হাস্যময় সেলস্‌গার্ল তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেন। তারাপদবাবু তাঁর প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করেন; শোকেসের দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করেন কিছুক্ষণ আগে পছন্দ করা মাফলারটির দিকে; মাফলার শব্দটি শুনেই সেলসগার্ল রীতিমত হকচকিয়ে যায়; সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে না পেরে তারাপদবাবুকে আবার জিজ্ঞেস করে যে তিনি ঠিক কী কিনতে এসেছেন; লেখক আবার ‘মাফলার’ শব্দটি উচ্চারণ করলে সেলস্‌গার্ল চূড়ান্ত বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে ‘মাফলার’!

লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী সেলসগার্ল তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে জরিপ করে জানায়, তাদের দোকানে মাফলার পাওয়া যাবে না; উল্টো দিকের দোকানে পাবেন। এবারে তারাপদবাবু ঘাবড়ে যান এবং এই ঘটনাক্রমের পিছনে স্বকপোলকল্পিত একটি যুক্তি খাড়া করে নেন; যুক্তিটি অনেকটি এরকম : এই দোকান শুধু প্রদর্শনের জন্য, বিক্রি হবে উল্টো দিকের দোকানে। উল্টো দিকের ফুটপাতে গিয়ে তারাপদবাবু দোকানের সাইনবোর্ডটি লক্ষ করেন। সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘উইলিয়াম, উইলিয়াম, উইলিয়াম অ্যান্ড উইলিয়াম অটোমোবিল স্টোরস্’। শোকেসে সাজানো গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। তারাপদবাবুর মনে খটকা লাগে; তবু মনে সংশয় নিয়ে তিনি ভেতরে ঢুকে পড়েন; ঢুকে দেখেন ভেতরে ছ’জন উইলিয়াম : সিনিয়র উইলিয়াম, জুনিয়র উইলিয়াম, র্গ্যানি উইলিয়াম, মাম্মি উইলিয়াম, এমএস উইলিয়াম ও মিস উইলিয়াম। সবচেয়ে প্রবীণ বলশালী সিনিয়র উইলিয়াম লেখককে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর প্রয়োজন। তারাপদবাবু ভয়ে ভয়ে জানতে চান, এখানে মাফলার পাওয়া যাবে কিনা! উত্তরে বিক্রেতা বলেন, ‘মাফলার পাওয়া যাবে না কেন? এটা তো মাফলারেরই দোকান’; এবং জানতে চান, তারাপদবাবুর গাড়িটি ঠিক কোথায় রাখা আছে এবং তাঁর কীরকম মাফলার লাগবে; প্রশ্ন শুনে লেখক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান; ভাবেন, দোকানদার হয়তো ভেবেছেন তিনি এক গাড়ি মাফলার কিনবেন। এরপর লেখক যখন জানান, তিনি গরিব ভারতীয়, তাঁর কোন গাড়ি নেই এবং তিনি নিউ ইয়র্কে বেড়াতে এসেছেন, তখন বৃদ্ধ সিনিয়র উইলিয়াম অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন ও দোকানের সমস্ত উইলিয়ামকে ডেকে এনে বলেন ‘লুক হিয়ার। হিয়ার ইজ এ ফানি গাই ফ্রম ইণ্ডিয়া’; ভারত থেকে এক মজার লোক এসেছে, যার কোন গাড়ি নেই, কিন্তু একটা মাফলার কিনতে চায়। পুরো উইলিয়াম পরিবার লেখককে মাঝখানে রেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অতি কষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচেন তারাপদবাবু।

পরে এই চূড়ান্ত বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, আমেরিকায় ‘মাফলার’ বলতে বোঝায় গাড়ির সাইলেন্সারকে; গাড়ি না থাকা সত্ত্বেও সাইলেন্সার কিনতে যাওয়ার কারণে এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল। শুধু বাজার করতে গিয়ে নয়, রেস্তোরাঁতেও এহেন শব্দার্থজনিত সমস্যা তাঁকে অসহায় করে তুলেছিল। পাশের টেবিলের লোক ডুমো ডুমো করে কাটা লোভনীয় আলুভাজা খাচ্ছেন দেখে তাঁর খাওয়ার ইচ্ছে হলেও তিনি খেতে পারেননি, কারণ আলু ভাজা তাঁর কাছে ‘পটেটো চিপস্’ হলেও আমেরিকানদের কাছে তা ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’; একইরকমভাবে বেগুন ‘ব্রিঞ্জল’ নয়, ‘এগ প্ল্যান্ট’, কমলালেবু ‘অরেঞ্জ’ নয়, ‘ট্যাঙ্গারিন’। মার্কিন মুলুকে লেখকের ইংরেজি শিক্ষা কোনো কাজে আসে না। মার্কিন ও ভারতীয় ইংরেজির শব্দার্থভেদের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে এই দৃষ্টান্তটি।

ভ্রমণ সাহিত্য স্বভাবগত কারণেই অসংখ্য স্থান পরিভ্রমণ করে। অসংখ্য স্থান মানেই অসংখ্য মানুষ। আর মানুষ থাকলেই ভাষা থাকবে। তাই ভ্রমণকাহিনিতে মিলবে অজস্র ভাষার আলাপ। সেভাবেই কোনো কোনো ভ্রমণ কাহিনিকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার। কেবল উক্ত তিনটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য ভ্রমণ কাহিনিতে ভাষাগত আলোচনা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভিয়েতনামে কিছুদিন গ্রন্থে যেমন ভিয়েতনামের স্থানীয় ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য, বর্ণমালা, পরিভাষা, শব্দকোষ আলোচিত হয়েছে; তেমনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পায়ের তলায় সরষে ১ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘আচমকা এক টুকরো ১’ রচনায় উল্লিখিত হয়েছে দুই সহযাত্রীর সাংকেতিক ভাষায় কথোপকথনের তাৎপর্য। ভ্রমণ কাহিনির পরিসরে ভাষিক আলোচনার এহেন উপাদানগুলো পাঠকের কাছে যেমন তথ্যপূর্ণ, তেমন মজাদারও বটে।
 


কৌশিক কর্মকার অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ—প্রতিভা বসুর কথাসাহিত্য : শৈলী প্রসঙ্গ (২০২০), জীবনানন্দের উপন্যাস : ভাষাশৈলী (২০২৫); সম্পাদিত গ্রন্থ : বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার (২০২৪), ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরা (২০২৪), Revival of Indian Knowledge System: A Boost to Holistic Education (২০২৪), ধ্রুপদী ভাষা বাংলা (২০২৪)। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।

menu
menu